• নিয়ম আছে, কিন্তু বাস্তবে রাতের রাস্তা নিরাপদ কতটা?
    এই সময় | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়: দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের মর্গের সামনে থেকে তনুশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের আর্ত চিৎকার ছিটকে আসছিল — ‘১৮ কিলোমিটার রাস্তা কি কম? অতটা পথ ধাওয়া করে পাঁচটা মদ্যপ ছেলে আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলল! কেউ দেখল না? পুলিশ কিছুই করতে পারল না?’ যদিও পুলিশের দাবি, হুগলির চন্দননগরের নাড়ুয়া রায়পাড়ার বাসিন্দা সুতন্দ্রার গাড়িই অন্য গাড়িটিকে চেজ় করছিল। কিন্তু, এ সব তর্ক–বিতর্ককে পাশে রেখে উঠে এসেছে সেই অমোঘ প্রশ্ন — মানুষ কতটা নিরাপদ?

    শহর ছাড়িয়ে যাঁরা নিয়মিত দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বা বম্বে রোড ধরেন, তাঁদের অনেকেরই দাবি, রাস্তার পাশে দৃশ্যত পুলিশকে দেখা যায় না। এমন কোনও ঘটনা ঘটলে কাকে জানাবেন, কেউ জানেন না। অথচ অন্য রাজ্যে, জাতীয় সড়কেও একটু দূরে দূরে দেখা যায় পুলিশের গাড়ি। অনেক জায়গায় জাতীয় সড়কের উপরে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা থাকে আপৎকালীন নম্বরও। এই রাজ্যেই নেই!

    মানতে নারাজ রাজ্যের পুলিশ কর্তারা। তাঁদের দাবি, প্রতিটি জাতীয় সড়কে বাধ্যতামূলক ভাবে এনএইচএআই (ন্যশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া)–এর নিজস্ব বোর্ড থাকে। সেখানে জরুরি নম্বর লেখা থাকে। জেলা ও স্থানীয় থানার নম্বরও থাকে। আমাদের রাজ্যেও রয়েছে। অথচ যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁদের অভিযোগ, দিনের বেলাতেই বোর্ড দেখা যায় না। রাতে তো দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার জন্য গ্লো–সাইন বোর্ডের প্রয়োজন। কেবলমাত্র টোল প্লাজ়া আসার কিছু আগে বোর্ড থাকে। মাঝেমাঝে দূরত্ব জানানোর মাইলফলকের জায়গায় বোর্ড দেখা যায়। কোথাও স্থানীয় এলাকার নাম থাকে। তবে, জরুরি নম্বর? মনে করতে পারছেন না অনেকেই।

    এনএইচএআই-এর নিয়ম — প্রতি পাঁচ কিমি অন্তর পুলিশের টহলদারি ভ্যান থাকবে। প্রতি এক কিলোমিটার অন্তর জরুরি ফোন নম্বর থাকবে। বিপদে পড়লে সেই নম্বরে সাহায্য পাওয়ার কথা। ওই নম্বর ফোন করলে পুলিশ, উদ্ধারকারী ক্রেন বা ভ্যান আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। জাতীয় সড়কের দু’দিকে এবং দুই লেনের বিভাজক হিসেবে রিফ্লেক্টর থাকা বাধ্যতামূল। ডিভাইডারে নির্দিষ্ট দূরত্বে আলো থাকবে। কোথায় এ সব? এনএইচএআই–এর এক কর্তাকে ফোন করা হলে ধরেননি। মোবাইলে মেসেজ পাঠালে জবাব পাওয়া যায়নি।

    রবিবার রাতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে পানাগড়ে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেটির দায় রাজ্য পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগ নিতে চায়নি। তাদের বক্তব্য, শুধু সমন্বয় করাই তাদের কাজ। আইন–শৃঙ্খলা থেকে যান–নিয়ন্ত্রণ — সমস্তই স্থানীয় পুলিশের কাজ। আসানসোল–দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুনীল কুমার চৌধরির কথায়, ‘১০০ ডায়াল করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। আপনি জাতীয় সড়ক বা জেলার যে কোনও জায়গায় বিপদে পড়়লে ১০০ ডায়াল করুন। আপনার কল স্থানীয় জেলা বা কমিশনারেটের কন্ট্রোল রুমে পৌঁছবে। সেখান থেকে আপনাার লোকেশন ট্র্যাক করে স্থানীয় থানাকে জানানো হবে। আপনার কাছাকাছি যেখানে পুলিশের টহলদারি ভ্যান থাকবে, সে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।’ রবিবারের ঘটনায় সুতন্দ্রাদের গাড়ি থেকে কেউ ১০০ ডায়ালে ফোন করেছিলেন কিনা, তা পরিষ্কার নয়। পুলিশও তেমন কিছুই জানায়নি।

    কিন্তু, আগেও তো হাইওয়েতে পুলিশের টহলদারি ভ্যান থাকত। এখন তারা কোথায়?

    কমিশনারের কথায়, ‘হাইওয়েতে যে স্পিডে গাড়ি যায়, তাকে আচমকা থামাতে গেলে অ্যাক্সিডেন্ট হবে। তা ছাড়া হাইওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে ধারণা হয়, পুলিশ লরির কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু ১০০ ডায়ালের সুবিধা আছে, তাই দৃশ্যত পুলিশ–গাড়ির প্রয়োজন হয় না। তা সত্ত্বেও গাড়ি থাকে। আর তা থাকে খানিকটা আড়ালে। আপনি হুশ করে চলে গেলে হয়তো আপনার চোখে না–ও পড়তে পারে।!

    সুতন্দ্রার পিসি মৌসুমি পালের অভিযোগ, ‘বহুবার তো ও (সুতন্দ্রা) ভিন রাজ্যে কাজের জন্য গিয়েছে। সেখানে গিয়ে কখনও বিপদে পড়েনি। শেষে নিজের রাজ্যেই কিছু মত্ত যুবকের থেকে বাঁচতে গিয়ে প্রাণ গেল?’ জাতীয় সড়কে নিরাপত্তা কোথায়? কাঁকসার ওসি- ট্রাফিক অনুপ হাটি–র কথায়, ‘আমাদের গাড়ি হাইওয়েতে থাকে। কিন্তু পানাগড় বাজার, যেটা পুরোনো জিটি রোড, সেখানে কোনও গাড়ি ছিল না।’ বুদবুদ থেকে পাঁচ কিমি পানাগড় বাইপাস মোড় পর্যন্ত তো রেষারেষি করা দু’টি গাড়ি জাতীয় সড়কেই ছিল। তা হলে সেখানে পুলিশের টহলদাড়ি গাড়ি দেখা গেল না কেন? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাওয়া যায় নি। তবে, পুলিশের একাংশের দাবি, না–আছে পর্যাপ্ত কর্মী, না–আছে গাড়ি। এক অফিসারের কথায়, ‘হাইওয়েতে গাড়ি রেখে কী হবে? সিনেমার মতো সে দোষী–গাড়িকে ধাওয়া করবে? আমাদের গাড়ির হাল দেখেছেন? যে স্পিডে অফেন্ডার যাবে, তাকে চেজ় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’

    হুগলি গ্রামীণ পুলিশের এক কর্তা জানান, ‘দিল্লি রোড ও দুর্গাপুরের মতো জাতীয় সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাতে পাঁচ কিমি অন্তর পুলিশের টহলদারি ভ্যান থাকে। রাজ্য ও জাতীয় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে নাকা চেকিং করা হয়। জাতীয় সড়কে কাজ চলছে। সেই কারণে সর্বত্র আলো নেই। কিন্তু পুলিশ আধিকারিকেরা রাতভর তদারকি বা নজরদারি চালান।’

  • Link to this news (এই সময়)