প্রদীপ চক্রবর্তী, চন্দননগর
পেশায় রেলের ঠিকাদার হলেও গানবাজনা করতেন বাবা। সেই সুবাদে বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই বড় হয়েছিলেন সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়। পাড়ার সব বাড়িতেই অবাধ যাতায়াত ছিল মিশুকে স্বভাবের সুতন্দ্রা ওরফে মাম-এর। ছোট থেকেই নাচের প্রতি ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসাকে পেশা করবেন বলে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে নাচের পেশাদারি তালিম নেন মাম।
সেই নাচের অনুষ্ঠান করতে গিয়েই যে এ ভাবে পথ দুর্ঘটনায় তরতাজা মেয়েকে অকালে চলে যেতে হবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারছেন না সুতন্দ্রার পরিবারের সদস্য এবং পড়শিরা। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে মা তনুশ্রী চট্টোপাধ্যায় সোমবার সকালেই দুর্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। মাত্র আট মাস আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সুতন্দ্রার বাবা সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছে।
বাড়িতে মা ছাড়াও রয়েছেন ঠাকুমা ও দিদিমা। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিলেন মাম–ই। বাড়িতে থাকলে পাড়ার কয়েকটি পথকুকুরকে দু’বেলা খাবার দিতেন তিনি। সেই রুটিনে হঠাৎ ছেদ পড়ল সোমবার দুপুরে। চন্দননগরের নাড়ুয়ায় মামের বাড়ির সামনে এ দিন ঠায় দাঁড়িয়েছিল সেই সারমেয়র দল। বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে না–দেখে দীর্ঘক্ষণ পরে ফিরে যায় তারা।
চন্দননগরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে স্নাতক হন সুতন্দ্রা। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার যে কোনও অনুষ্ঠানে সুতন্দ্রার নাচ ছিল মাস্ট আইটেম। শুধু নিজেই নন, বাড়ির অদূরে নাড়ুয়া রায়পাড়া বারোয়ারি দুর্গাপুজোর মণ্ডপে পাড়ার ছোটদের নিয়ে নাচের অনুষ্ঠানও করতেন মাম।
প্রথমে অন্য দলের হয়ে নাচের অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকলেও বছর কয়েক আগে নিজের চেষ্টাতেই নিজের নাচের দল ‘মুন ওয়াক’ তৈরি করেন সুতন্দ্রা। নিজের বাড়ির ছাদেই নাচের মহড়া চলত। বর্ধমান, ভদ্রেশ্বর ও চুঁচুড়া থেকে দলের নৃত্যশিল্পীরা আসতেন। সুতন্দ্রার দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০ জন। বিয়ে-সহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত সুতন্দ্রার দলের। নাচের দলের শিল্পীদের রাখার জন্য গয়ায় একটি ফ্ল্যাটও ভাড়ায় নিয়েছিলেন সুতন্দ্রা। এ বার সরস্বতী পুজোর সময়ে গয়ায় তাঁরা একটি অনুষ্ঠানও করে এসেছিলেন।
সুতন্দ্রার পাড়ার বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন পথকুকুরদের দুপুর ও রাতে নিয়ম করে খাবার দিতেন সুতন্দ্রা ও তাঁর মা। বাড়িতেও একটি পোষা কুকুর ছিল তাঁর। সোমবার দুপুরে মামের বাড়ির সামনে সেই কুকুরের দলই ভিড় করেছিল। সুতন্দ্রার নাচের দলের সিংহভাগ সদস্য ট্রেনেই গয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রেনের টিকিট কনর্ফামড হয়নি বলে নিজের গাড়িতে করেই দলের তিন সদস্যকে নিয়ে গয়া রওনা হন সুতন্দ্রা। সুতন্দ্রার মা তনুশ্রীর কথায়, ‘রাত ১২টার কিছু আগে শেষবার ওর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল। মামুলি দু’চারটে কথা হয়। তখনও গোলমালের কোনও কথা বলেনি।’
সুতন্দ্রার এক সহ-শিল্পী বিশ্বজিৎ রায় বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখেছি। আমরা একসঙ্গে বিহারে অনেক নাচের অনুষ্ঠান করেছি। খুবই ভালো মনের মেয়ে ছিল। পাড়ার কুকুরদের যত্ন করত। বাবার মৃত্যুর পর মা-ঠাকুমা-দিদিমাকে আগলে রেখেছিল। এক ঝটকায় সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’ এক নাগাড়ে কথাগুলি বলে কেঁদে ফেলেন বিশ্বজিৎ। কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওঁর ঠাকুমা, দিদিমাকে কিছু বলিনি। রাতে মামের দেহ বাড়িতে এলে কী জবাব দেবো?’