• ৬৩ বছরে MA পাশ, পিএইচডি-তে নজর শান্তিপুরের চাষির
    এই সময় | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়, কৃষ্ণনগর: ‘কোনও অবস্থাতেই হাল ছেড়ো না। কারণ সময় যখন সবচেয়ে খারাপ, তখনই স্রোত নতুন দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে…।’ ১৯৭৮ সালের বন্যায় বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার পরে কার্যত নিঃস্ব হয়ে নিজেকে এ ভাবেই বুঝিয়েছিলেন নদিয়ার শান্তিপুরের লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বনাথ প্রামাণিক।

    সেই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেননি ‘কিশোর’ বিশ্বনাথ। বন্যা-দুর্ভোগ কাটার পরে তাঁদের পরিবার প্রবল আর্থিক অনটনে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে চাষের কাজে নামতে হয়েছিল বিশ্বনাথকে। একটু বড় বয়সে ভাইদের পড়াশোনার খরচ এবং বোনেদের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে থেকে গিয়েছেন অকৃতদার। পড়াশোনাও করা হয়ে ওঠেনি তখন।

    কিন্তু পড়ার ইচ্ছেটাকে জিইয়ে রেখেছিলেন। ২০১৬ সালে রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর ধাপে ধাপে উচ্চ মাধ্যমিক, গ্র্যাজুয়েশনও করেন। ৬৩ বছর বয়সে পৌঁছে এ বার বাংলায় এমএ করলেন বিশ্বনাথ।

    সবাইকে চমক দিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, ‘১৯৭৮-এর বন্যায় বাড়িতে প্রচুর জল ঢুকেছিল। সবাই মিলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। এক মাস ধরে কখনও ত্রাণ শিবিরে, কখনও আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। বই-খাতা সব ভেসে গিয়েছিল বানের জলে। পরের বছর মাধ্যমিক দিতে পারিনি। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বড় ছিলাম বলে বাবার সঙ্গে চাষের কাজে নামতে হয়। পড়ার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে লুকিয়েই ছিল।’

    এক গাল হাসি নিয়ে বলেন, ‘২০২১-এ করোনার মধ্যেও নেতাজি ওপেন ইউনিভার্সিটির শান্তিপুর কলেজ কেন্দ্র থেকে বিএ পাশ করি। এরপর এমএ করব না, এটা হয়? এ বছর একই কেন্দ্র থেকে বাংলায় এমএ পাশ করে খুবই ভালো লাগছে। দিন ১৫ আগে অনলাইনে পরীক্ষার ফল জেনেছি। রবিবার কেন্দ্র থেকে মার্কশিট হাতে পেয়েছি।’

    নেতাজি সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির শান্তিপুর কলেজ কেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর পলাশ দাসের কথায়, ‘বিশ্বনাথ নিশ্চিত জানেন এই ডিগ্রি অর্জন করলেও ৬৩ বছর বয়সে চাকরি পাবেন না। তবু পরীক্ষায় বসেছিলেন। উত্তীর্ণ হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। পড়াশোনার প্রতি গভীর টান ও ভালবাসা না-থাকলে এটা অসম্ভব।’ ওই কেন্দ্রের এক অশিক্ষক কর্মী বিশ্বজিৎ রায় বলেন, ‘ওঁর হাতে মার্কশিট তোলার সময়ে স্যালুট করেছি। যে ৫০ জন এ বছর এমএ পাশ করেছেন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর বিশ্বনাথের।’

    এ দিকে বিশ্বনাথ এখন জেদ ধরেছেন, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগ থেকে পিএইচডি করতে চান তিনি। চাকরি নয়, চান গ্রামের আগ্রহী অথচ অভাবী পড়ুয়াদের পড়াতে। নিজে অভাবটা দেখেছেন বলেই বোঝেন এর মর্ম।

    পুরোনো দিনের কথা আউড়ে বিশ্বনাথ জুড়লেন, ‘কষ্টটা জানি। তাই ঠিক করেছি, অর্থাভাবে প্রাইভেট টিউটর রাখতে না-পারা গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াব। এখন আমাদের ১৩ বিঘে জমি রয়েছে। নিজে এখনও রোজ দু’বেলা চাষের কাজ করি। এরই ফাঁকে না-হয় একটু স্বেচ্ছাশ্রম দিলাম। ক্ষতি কোথায়?’

  • Link to this news (এই সময়)