• পানাগড়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় নয়া মোড়, ক্রেটার মালিক বাবলু গাড়িতেই ছিলেন,রয়ে গেল ধোঁয়াশা, বদল বয়ানেও
    এই সময় | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়, দুর্গাপুর ও চন্দননগর: সোমবার অভিযোগ উঠেছিল ইভটিজ়িংয়ের। মঙ্গলবার জানা গেল, পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে ইভটিজ়িংয়ের উল্লেখ নেই! যা অভিযোগ রয়েছে, তার ভিত্তিতে পুলিশ অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করেছে। সোমবার পুলিশ সূত্রে দাবি করা হয়েছিল, ক্রেটার মালিক বাবলু যাদব, তবে তিনি গাড়িতে ছিলেন না। মঙ্গলবার পুলিশই জানিয়েছে, রবিবার রাতে এক্সপ্রেসওয়েতে রেষারেষির সময়ে ক্রেটার স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন বাবলুই। যাঁর ব্যবসা ঘিরে বিভিন্ন ধূসর ‘বয়ান’ রয়েছে এলাকায়।

    রবিবার রাতে, পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ের কাছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস চিরে ছুটে যাওয়া নৃত্যশিল্পী সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়ের তিয়াগো গাড়িকে সাদা রঙের ক্রেটা তাড়া করেছিল বলেই উঠে এসেছিল অভিযোগ। যার জেরে দুর্ঘটনায় পড়ে তিয়াগো এবং মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সুতন্দ্রার (২৭)।

    তিয়াগোর গাড়িচালক রাজদেও শর্মা সোমবার সর্বসমক্ষে অভিযোগ করেছিলেন, ক্রেটার যাত্রীরা মদ্যপান করছিলেন এবং সুতন্দ্রাকে লক্ষ্য করে অশালীন ইঙ্গিত করছিলেন। মঙ্গলবার জানা গিয়েছে, সেই প্রসঙ্গই নাকি অভিযোগে নেই। কেন? মঙ্গলবার দুপুরে চন্দননগরে সুতন্দ্রার বাড়িতে রাজদেও ঢোকার সময়য়ে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, ‘আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। এখন কিছু বলার অবস্থায় নেই। পরে বেরিয়ে বলছি।’ পরে রাত পর্যন্ত তাঁকে বেরোতে দেখা যায়নি। তবে সে দিন গাড়িতে থাকা সুতন্দ্রার সহকর্মী মিন্টু মণ্ডল বিকেলে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের দেখে তড়িঘড়ি মোটরবাইকে করে বেরিয়ে যেতে চান। তাঁকে সবাই ঘিরে ধরলে বলেন, ‘যা বলার পুলিশকে বলেছি।’ এ কথা বলেই পড়িমরি করে ফের মোটরবাইক থেকে নেমে সুতন্দ্রার বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন তিনি। এই মিন্টুকে দিয়েই লিখিত ভাবে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করানো হয়েছে। মিন্টুও সোমবার সাংবাদিকদের সামনে ইভটিজ়িংয়ের অভিযোগ করেছিলেন।

    ঘটনার পরে সুতন্দ্রার মা তনুশ্রীও ইভটিজ়িংয়ের অভিযোগ করেছিলেন। এমনকী মঙ্গলবার দুপুরে আরও কড়া প্রতিক্রিয়া শোনা যায় তাঁর গলায়। বলেন, ‘লক্ষ্মীই যদি ঘরে না–থাকে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নেবেটা কে?’ রাজদেওয়ের বয়ান কী ভাবে বদলে গেল তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শোনা যায় তাঁকে। অথচ এ দিনই বিকেলের পরে খানিকটা নরম হতে দেখা যায় তনুশ্রীকে। রাজদেও বা মিন্টুর বয়ান বদলে গেলেও আপনি কি আলাদা করে ইভটিজ়িংয়ের অভিযোগ আনবেন? তনুশ্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘পুলিশের উপরে আমার আস্থা রয়েছে।’ তবে তার পরেই বলেন, ‘আমরা কোনওরকম বয়ান বদল করিনি। আমরা ইভটিজ়িংয়ের বিষয়টা আলাদা রাখছি। যে গাড়িটা ধাওয়া করেছিল, তার যাত্রীরা মদ্যপ অবস্থায় ছিল। সেই গাড়ি থেকে মদের গ্লাস, বোতল পাওয়া গিয়েছে। ইভটিজ়িং বা কটুক্তি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বা তুলে করা হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। কোনও মেয়ে সেফ নয়। এখনও পুলিশের উপর আস্থা রাখছি।’

    স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসেছে বেশ কিছু প্রশ্ন। যার উত্তর মেলেনি। রাজদেও সোমবার ইভটিজ়িংয়ের অভিযোগ করলেও অভিযোগপত্রে তার উল্লেখ নেই কেন? কাঁকসা–র এসিপি সুমন জয়সওয়ালের দাবি, ‘সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি দেখার পরে পরিষ্কার হয়ে যায় কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই ছবি দেখে গাড়িচালক ও আরোহীরা ঘাবড়ে যান। তখন তাঁরা স্বীকার করে নেন ইভটিজ়িংয়ের কোনও ঘটনা ঘটেনি।’ তবে কি চোখের সামনে সুতন্দ্রার মৃত্যু দেখার পরে ঠান্ডা মাথায় গল্প ফেঁদেছিলেন রাজদেও ও মিন্টু? দোষ না–করলে ক্রেটা ফেলে বাবলুরা কেন পালিয়ে গেলেন?

    এরকম বেশ কিছু বিপরীতমুখী বয়ান, প্রশ্ন ও ধোঁয়াশাকে সামনে রেখে মঙ্গলবার সকালে বাবলুর খোঁজে পানাগড় কাবাড়িপট্টিতে তাঁর বাড়িতে যায় পুলিশ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাঁকসা–র এসিপি সুমন জয়সওয়াল বলেন, ‘বাবলু গাড়ি চালাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’ বাবলুর পরিচারক জিয়ালাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় বাবলু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে চার বন্ধু ছিলেন। আর বাড়ি ফেরেননি। কোথায় আছেন জানি না।’ পুলিশের দাবি, বাবলুর খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলছে। গাড়ির বাকি আরোহীদেরও খোঁজ চলছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাবাড়িপট্টিতে ‘পাতিবাবলু’ বলে খ্যাত এই যুবক পুরোনো গাড়ির স্প্রিং ও পাতির ব্যবসা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে চোরাই গাড়ি কেনা–বেচার যেমন অভিযোগে রয়েছে, তেমনই পুলিশের একাংশের সঙ্গে তাঁর ‘ওঠাবসা’ সম্পর্কে স্থানীয়দের প্রশ্ন তুলতে শোনা গিয়েছে।

    রবিবার রাতে দুর্ঘটনার পর থেকে মিন্টু, রাজদেও এবং তিয়াগোর আরও দুই যাত্রী কাঁকসা থানাতেই ছিলেন। বাকি দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সোমবার রাত একটা পর্যন্ত মিন্টু ও রাজদেও থানাতেই ছিলেন! এর মাঝে দুপুরে থানা থেকে একটু সময়ের জন্য বেরিয়ে মিন্টু ও রাজদেও — দু’জনেই ইভটিজ়িংয়ের অভিযোগ আনেন। পরে বদলে যায় বয়ান। পুলিশের দাবি, মিন্টু যে লিখিত অভিযোগ করেছেন, তা তনুশ্রীকে দেখানোর পরে তিনি জানিয়েছেন, ‘ঠিক আছে’। এরপরে ওই অভিযোগটি এফআইআর হিসেবে গণ্য করা হয়। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) ২৮১/১২৫(এ)/ ১০৫/৩২৪(৪) ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ।

    তা হলে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল? এসিপি বলেন, ‘বুদবুদে তেল ভরার পরে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলে আসে। তাদের মধ্যে ধাক্কা লাগলে ক্রেটাকে ধাওয়া করে তিয়াগো। ক্রেটা জাতীয় সড়ক ছেড়ে পানাগড় বাজারে ঢুকে যায়। রাইসমিল গলির কাছে সিসিটিভি ক্যামেরার ছবিতে দেখা গিয়েছে আগে ক্রেটা, পিছন থেকে তিয়াগো ধাওয়া করে এসে ক্রেটাকে ধাক্কা মেরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়।’

    মঙ্গলবার সকালে সিআইডির প্রতিনিধি দল কাঁকসা থানায় এসে দু’টি গাড়িই পর্যবেক্ষণ করে। বিকেলে থানায় এসে দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি দু’টি পর্যবেক্ষণ করেন ডিসি (পূর্ব) অভিষেক গুপ্তা। এ দিন দুপুরে রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য সুজাতা পাকড়াশি লাহিড়ী তনুশ্রী ও পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলেন। বিকেলে বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল সেখানে পৌঁছে বুধবার কাঁকসা থানা ঘেরাও করার হুঁমকি দেন।সন্ধ্যায় চন্দননগরের পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারা সুতন্দ্রার বাড়িতে আসেন। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহন্মদ সেলিম ও মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন।

    এ দিন পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়ি ও দোকান বন্ধক রেখে ব্যাঙ্ক থেকে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সুতন্দ্রার বাবা সুকান্ত চট্ট্যোপাধ্যায়। কাকতালীয় ভাবে রবিবার রাতে সুতন্দ্রার মৃত্যুর পরে সোমবারেই পালপাড়ার দোকান দখলের বিঞ্জপ্তি দেয় চন্দননগরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। তনুশ্রী ঋণের কথা স্বীকার করে জানান, স্বামী ক্যান্সারে আক্রান্ত হতেই ব্যবসা–বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। স্বামীর চিকিৎসা করাতেই বাড়ি ও দোকান বন্ধক রাখতে হয়। ন’মাস আগে মারা যান সুকান্ত।

  • Link to this news (এই সময়)