পিসিশাশুড়ি খুনে ধৃত মেয়ে-মা, ব্যাগবন্দি দেহ লোপাটের চেষ্টা কুমোরটুলির গঙ্গায়
বর্তমান | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: সাতসকালে কুমোরটুলি ঘাটে ব্যাগবন্দি দেহ! আর তাতেই তোলপাড় পড়ে গেল কলকাতা থেকে গোটা রাজ্যে। তখনও আড়মোড়া ভেঙে পুরোদস্তুর ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি মঙ্গলবারের কলকাতা। সকাল ৭টা ১৫-২০ হবে। কুমোরটুলির গঙ্গার ঘাটে রেললাইনের পাশে বাড়ির দোতলা থেকে মধুমিতা পাত্র, সুস্মিতা কয়ালরা লক্ষ করলেন, দুই মহিলা সাদা রঙের একটি ট্যাক্সি থেকে নামল। ডিকি থেকে নীল রঙের একটি ব্যাগ নামাল তারা। ট্যাক্সি চলে যেতেই ব্যাগটা টানতে টানতে যেতে শুরু করল ঘাটের দিকে। আচরণে সন্দেহ হওয়ায় নেমে আসেন মধুমিতা, সুস্মিতারা। দেখেন, ব্যাগ টেনে নিয়ে যাওয়ার রাস্তায় রক্তের দাগ। ততক্ষণে আরও লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। দুই মহিলা প্রথমে দাবি করে, কুকুর মারা গিয়েছে। সেই দেহ তারা গঙ্গায় ফেলতে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী মধুমিতাদেবী বলছিলেন, ‘ওদের কথাবার্তায় সন্দেহ হচ্ছিল। তাই আমরা ব্যাগটা ফেলতে দিইনি। ব্যাগে প্যাডলক লাগানো ছিল। আমরা রক্তের দাগ দেখতে পাই। বাজে গন্ধও আসছিল। একটা গামছা ছিল, তাতেও রক্তের দাগ। আমরা পুলিসে খবর দিই।’ উত্তর বন্দর থানার পুলিস এসে দুই মহিলাকে আটক করে ব্যাগ সহ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ব্যাগ খুলতেই ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! দু’পায়ের গোড়ালি কেটে একটি নারীদেহকে দুমড়েমুচড়ে ঢোকানো হয়েছে ব্যাগে। দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে।
দুই মহিলাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই অনেকটা স্পষ্ট হয় হাড়হিম ঘটনার রহস্য। পুলিস জানিয়েছে, মৃতার নাম সুমিতা ঘোষ (৫৫)। ব্যাগে ভরে দেহ ফেলতে আসা দুই মহিলা ফাল্গুনী ঘোষ ও তার মা আরতি ঘোষ। সুমিতাদেবী ফাল্গুনীর পিসিশাশুড়ি। সুমিতাদেবী অসমের জোরহাটের বাসিন্দা। বিবাহবিচ্ছিন্না। তাঁর প্রাক্তন স্বামীর বাড়ি বর্ধমানের নাদনঘাটে। বনিবনা না হওয়ায় ফাল্গুনীও স্বামীর সঙ্গে থাকে না। মা-মেয়ের ঠিকানা মধ্যমগ্রামের বীরেশপল্লির ভাড়াবাড়ি। ১১ ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহে বোনের বাড়ি থেকে মধ্যমগ্রামে আসেন সুমিতাদেবী। জিজ্ঞাসাবাদে দু’জন জানিয়েছে, টাকা-পয়সা ও গয়না আদায় নিয়ে তাদের সঙ্গে সুমিতাদেবীর গোলমাল চলছিল। সোমবার বিকেল ৪টে নাগাদ ঝগড়াঝাঁটি শুরু হলে ফাল্গুনী ও তার মা সুমিতাদেবীর মাথা সজোরে দেওয়ালে ঠুকে দেয়। জ্ঞান হারান প্রৌঢ়া। জ্ঞান ফিরলে ইট দিয়ে ফের তাঁর মাথায় ও মুখে আঘাত করে তারা। মৃত্যু হয় সুমিতাদেবীর। দেহ লোপাটের প্ল্যান শুরু করে দেয় মা-মেয়ে। রাতেই মধ্যমগ্রাম থেকে ট্রেনে পার্ক সার্কাস চলে আসে। ওখানে খুব সুবিধা হবে না বুঝে কুমোরটুলি গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দেহ ফেলে দেবে বলে ঠিক করে তারা। এরপর রাতের মধ্যে তারা দেহটি স্ট্রলিব্যাগে ভরে ফেলে। অত বড় শরীরটা ম্যানেজ করতে অসুবিধা হওয়াতেই মৃতদেহের গোড়ালি ধারালো বঁটি দিয়ে কেটে ফেলা হয়। তারপর মঙ্গলবার ভোররাতে একটি রিকশয় ব্যাগ তুলে তারা দোলতলায় আসে। সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে কুমোরটুলি ঘাট। ফাল্গুনী ও আরতিকে গ্রেপ্তার করে খুন, প্রমাণ লোপাট ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে পুলিস। কলকাতার সিপি মনোজকুমার ভার্মা বলেন, ‘স্বতঃপ্রণোদিত খুনের মামলা রুজু করে দুই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এদিন সন্ধ্যায় ফাল্গুনীকে নিয়ে মধ্যমগ্রামের বাড়িতে যায় পুলিস। সঙ্গে ছিল ফরেন্সিক টিমও। খুনে ব্যবহৃত ইটটি উদ্ধার করেছে তারা। পা কাটার পর বঁটিটি পাশের পুকুরে ফেলে দেওয়া হয় বলে জেরায় জানিয়েছিল ফাল্গুনী। আজ সেটির খোঁজে তল্লাশি চালাবেন তদন্তকারীরা।কীভাবে খুন ও দেহ লোপাট
সোমবার বিকেল চারটে নাগাদ পিসিশাশুড়ির সঙ্গে বিবাদ ফাল্গুনীর
দেওয়ালে মাথা ঠুকে দেওয়া হয়। জ্ঞান হারান সুমিতা
জ্ঞান ফিরলে ফের মারধর
ইট দিয়ে মাথা, মুখ থেঁতলে খুন প্রৌঢ়াকে
গোড়ালি থেকে পা কেটে ব্যাগে ভরা হয় দেহ
ভ্যানে চাপিয়ে মধ্যমগ্রামের দোলতলা মোড় পর্যন্ত আনা হয় ব্যাগ
ট্যাক্সির ডিকিতে ভরে কুমোরটুলি ঘাটে দেহ ভর্তি ব্যাগ গঙ্গায় লোপাট করতে নিয়ে আসা হয়