আর কোনওদিন তালব্য ‘শ’ উচ্চারণ করতে পারবেন না হরিপদ। শুধু তালব্য ‘শ’ কেন, ‘চ’, ‘ছ’, ‘জ’–এর মতো আর যত তালব্য বর্ণ রয়েছে, কোনওটাই পরিষ্কার করে উচ্চারণ করতে পারবেন না তিনি। কারণ, বাঘে তাঁর আসল তালু নিয়ে চলে গিয়েছে।
‘সাদামাটা’ হরিপদ–র চেহারাটা কিন্তু ‘ছোটখাটো’ ছিল না। প্রায় ছ’ফুটের লম্বা–চওড়া চেহারাটার উপরে গত সাত মাস ধরে প্রায় সাতটা মেজর অপারেশন হয়েছে। মাইনর অপারেশন হয়েছে অগুনতি। এই অবর্ণনীয় লড়াইয়ে অনেকটাই ছোট হয়ে গিয়েছে তাঁর চেহারা। আগের মতো সুন্দরবনের খাঁড়িতে তাঁকে জাল ফেলতে দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় রয়েছে পরিবারের মধ্যে।
এসএসকেএম হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি–র প্রধান ডাক্তার অরিন্দম সরকারের কথায়, ‘মাছ ধরা! আরে উনি যে বেঁচে আছেন, এটাই অনেক। আমি–আপনি হলে বাঁচতাম না। এমন জীবনীশক্তি দেখা যায় না।’ তিনিই জানিয়েছেন, বাঘ থাবা মেরে হরিপদ–র নিজস্ব তালুর একটা বড় অংশ নিয়ে চলে যায়। পরে প্লাস্টিক সার্জারি করে সেই তালু পুনর্গঠন বা ‘রি–কন্সট্রাক্ট’ করা হয়। ডাক্তার অরিন্দমের কথায়, ‘রি–কন্সট্রাক্ট করার পরেও, আসল তালুর সঙ্গে ফারাক থেকে গিয়েছে। তাই, কোনওদিনই তিনি তালব্য বর্ণ উচ্চারণ করতে পারবেন না।’
কেমন আছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির রামপুরগ্রামের জেলে, ৩৫ বছরের হরিপদ দাস?
ফোনে তাঁর দাদা বাপি জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে দু–একটা কথা বলতে পারছেন। বিছানায় শোওয়া। শরীর খুবই দুর্বল। প্রচুর ওষুধ খেতে হচ্ছে। আর খাবার বলতে শুধু লিকুইড। মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হন। অপারেশন হয়। আবার বাড়ি ফিরে আসেন। কখনও হাসপাতালে চেক–আপ করাতে যেতে হয়।
গত ৩ জুলাইয়ের ঘটনা। মাতলায় ভাসছিল নৌকো। হরিপদর সঙ্গে শ্রীদাম মণ্ডল ও প্রতীপ নস্কর ডাঙা থেকে প্রায় ১৫ ফুট ভিতরে নৌকো নোঙর করে জাল ফেলে মাছ ধরছিলেন। সকাল প্রায় ১০টা। হরিপদদের মুখ ছিল মাতলার দিকে। পিছনের ডাঙা থেকে আচমকাই লাফ দেয় বাঘ। উড়ন্ত অবস্থাতেই হরিপদর মাথায় থাবা দিয়ে মুখে কামড় মারার চেষ্টা করে। ঝটকা মারে হরিপদ। টাল খেয়ে যায় নৌকো। শ্রীদামের বয়ান অনুযায়ী, বাঘ সম্ভবত ডাঙা আর নৌকোর মাঝের দূরত্বটা ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি। লাফটা একটু বড়ই দিয়ে ফেলেছিল। সে যদি নৌকোয় পড়ত, তিনজনকেই সাবাড় করে দিত। কিন্তু, সে লাফ দিয়ে নৌকো থেকে প্রায় পাঁচ ফুট উপর দিয়ে উড়ে যায়। ওই যাওয়ার সময়েই হরিপদকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, পারেনি। হরিপদর ঝটকা আর নিজের গতিবেগে সে নৌকো ছাড়িয়ে মাতলার জলে গিয়ে পড়ে।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। শিকার ফসকে মাতলার জলে পড়ে, মুখ ঘুরিয়ে আবার সাঁতরে নৌকোর দিকে আসতে শুরু করে বাঘ। বাঘের চাপড় খেয়ে ততক্ষণে হরিপদও নৌকোর অন্য পাশে জলে পড়ে গিয়েছিলেন। শ্রীদামের কথায়, ‘আমরা দু'জনে ওকে টেনে তুলি। নৌকো ছেড়ে দিই মাঝ নদীর দিকে। বাঘ সাঁতরে ডাঙায় উঠে আমাদের পিছু নেয়। আমরা জলে জলে চলছিলাম, আর আমাদের দেখতে দেখতে বাঘ ডাঙায় ডাঙায় চলছিল। কিছুক্ষণ পরে হাল ছেড়ে সে জঙ্গলে ঢুকে যায়। ওই অবস্থায় প্রায় দু'ঘণ্টা নৌকো চালিয়ে কৈখালি আশ্রমের কাছের ঘাটে রক্তাক্ত হরিপদকে নামাই।’ সেখান থেকে এসএসকেএম।
কার্যত বাঁচার আশা ছিল না। ডক্টর অরিন্দমের বক্তব্য ছিল — ‘নতুন দইয়ের হাঁড়ি থেকে হাতা দিয়ে দই কেটে নেওয়ার মতো করে মাথার পিছন থেকে ডান দিকের গলা পর্যন্ত চেঁছে নিয়েছিল বাঘ।’ ডাক্তারদের দল অপারেশন টেবিলে ট্র্যাকিওস্টমি করেন। শ্বাসনালী ছিঁড়ে সেখান দিয়ে রক্ত ঢুকছিল ফুসফুসে। মাথার খুলি-মুখের ডান দিক-ঘাড়ের পিছনে বড়সড় ইনজুরি ছিল। ডান দিকের নীচের চোয়াল বাঘে খুবলে নিয়েছিল। ডান দিকের উপরের চোয়াল এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তা-ও বাদ দিতে হয়। শুধু চোখ দু'টো বেঁচে যায়।
বাপিও সুন্দরবনের নদী–নালায় ঘুরে ঘুরে মাছ ধরেন। বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি থাকলেও পেট চালাতে হবে তো। হরিপদকে নিয়ে প্রতিবার কলকাতায় যাতায়াতে পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে। এক–দু’মাস অন্তর অন্তর ডাক্তারবাবুরা ডেকে পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়াও রয়েছে ওষুধ–পথ্যের খরচ।’ ভাইয়ের খরচ চালাতে তাঁর খাটনিও বেড়েছে।
‘আমাদের হাসপাতালের ডাক্তাররা সে অর্থে অসাধ্য সাধন করেছেন,’ বলছেন এসএসকেএম–এর ডিরেক্টর ডাক্তার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাক্তার অরিন্দমের কথায়, ‘কবে পুরোপুরি সুস্থ হবেন, বলতে পারব না। বহুদিন অচেতন অবস্থায় ভেন্টিলেশনে ছিলেন। তার দীর্ঘ এফেক্ট রয়েছে। চেস্ট–এ মেজর ইনফেকশন ছিল। আরও অনেক সার্জারি বাকি।’ ডাক্তারদের দাবি, এই ধরনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেশেন্ট কার্ডিয়াক শক–এ চলে যায়।
কিন্তু, হরিপদ যাননি। ‘সাদামাটা ছোটখাটো লোক’ হয়ে বেঁচে থাকাই এখন তাঁর ভবিতব্য।