কৌশিক দে, মালদা
শিক্ষার ভিত তৈরি হয় জীবনের একেবারে গোড়ায়। ছাত্রদের মধ্যে সেই জাগরণ গড়ে তুলতে উদয়ন পণ্ডিতরা বারেবারে ফিরে এসেছেন। লড়াই করে ছাত্রদের লেখাপড়ায় ও স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলির পঠনপাঠনের হাল ও সেখানরকার পরিকাঠামোগত সমস্যার ফলে সেখানে আর ছেলেমেয়েদের পাঠাতে চাইছেন না অভিভাবকরা।
কিন্তু মালদার বালুপুর এসসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্রটা একটু অন্যরকম। কারণ, সেখানে একজন ‘উদয়ন পণ্ডিত’ রয়েছেন। কখনও জাদুকাঠি নিয়ে আবরা–কা–ডাবরা গিলিগিলি ছু্...কখনও আবার তাঁর মুখে শোনা যায় নানা সব পাখির কিচিরমিচির ও পশুদের ডাক। আবার কখনও শুরু করেন রীতিমতো স্ট্যান্ড আপ কমেডি। তাই খুদেরাও মিস করতে চায় না স্যারের ক্লাস।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কচিকাঁচাদের স্কুলমুখী করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সেখানে মালদার বালুপুর এসসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক কাঞ্চনকুমার ঘোষের ক্লাসের ফাঁকে হাস্যকৌতুক, ম্যাজিক আবার কখনও পশু-পাখির ডাক শুনতে প্রতিদিন স্কুলে ছুটে আসছে শতাধিক পড়ুয়া। ইংরেজবাজারের ফুলবাড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম হিসেবে পরিচিত বালুপুর।
সেখানকার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের এই পরিকল্পনায় স্কুলছুটের হার তো কমেছেই। দিনদিন বাড়ছে পড়ুয়া সংখ্যা। কাঞ্চনের কথায়, ‘এখন এই স্কুলে মোট তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। তাঁরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। পড়ুয়া সংখ্যা প্রায় ১২৫। প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত স্কুল। ইংরেজবাজার শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের এই প্রান্তিক স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ভালো নয়। গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসার আগ্রহী তৈরি করতে আমিই এ সব চিন্তাভাবনা করেছি।’
গ্রামবাসীও স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁদের বক্তব্য, মাস্টারমশাই তো অনেক আগেই অন্য স্কুলে চলে যেতেন। কিন্তু ওঁকে অনুরোধ করে আটকে দেওয়া হয়েছে। গত ৩১ বছর ধরে বালুপুর এসসি প্রাথমিকেই শিক্ষকতা করছেন তিনি। প্রতিদিন টিফিন ব্রেক ও ছুটির আগে কিছুক্ষণ তিনি পড়ুয়াদের সঙ্গে এই ভাবে সময় কাটান। আবার কখনও মাউথ অরগ্যান বাজিয়েও শোনান ছাত্রছাত্রীদের।
কাঞ্চন আরও বলেন, ‘খুদেরা আমাকে ছাড়তেই চায় না। সব সময়ে বায়না ধরে জোকস আর পশু–পাখির ডাক শুনবে বলে। এরই মধ্যে ওদের পড়া বোঝাই। আমার কথামতো ওরা রোজ হোমওয়ার্কও করে আনে, নিয়মিত স্কুলেও আসে। ইতিমধ্যে আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক স্তরে মেধার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।’
জানা গিয়েছে, গতবছর জেলা প্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তৃতীয় ও স্কুলের পাঠনপাঠনে প্রথম হয়েছে এই স্কুল। একটু উপস্থিত বুদ্ধি আর সদিচ্ছা থাকলে কিছুই অসম্ভব নয় বলে জানান তিনি। গ্রামের প্রধান জীবিকা দিনমজুরি বা মৎস্যচাষ। দুঃস্থ পরিবারের অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখান না। সেখানে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের এই উদ্যোগের তারিফ করেছেন এলাকার সচেতন মহল। ওই শিক্ষকের জন্যই স্কুলের সুনাম বেড়েছে, তা এক কথায় মানছেন স্থানীয় মানুষজন।