মহম্মদ মহসিন, বাগনান
কয়েকদিন পরে শুরু হতে চলেছে পবিত্র রমজান মাস। তার আগে বাগনান বাইনান রাস্তার পাশে খাজুট্টি মল্লিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সামনে দেখা গেল সিংহভাগ মহিলা–সহ কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। মানুষগুলোর চোখেমুখে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। গনগনে রোদ উপেক্ষা করেও তাঁরা অপেক্ষা করছেন। চোখে যেন অলীক কোনও আশার ঝিলিক!
একজন মহিলাকে দেখা গেল। ওইসব মানুষদের একটা করে প্যাকেট বিতরণ করছেন তিনি। কী আছে প্যাকেটে? দু’কিলো করে ছোলা, চিনি ও এক প্যাকেট করে খেজুর। প্রসঙ্গত, রমজান মাসে দিনের শেষে রোজা ভাঙার সময়ে উপবাসকারীরা সাধারণত খেজুর, ছোলা, শরবত খেয়ে থাকেন।
রমজান মাসে ইফতারের সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছেন সোসাইটির চেয়ারপার্সন বিশিষ্ট সমাজসেবী, অনাবাসী ভারতীয়, ছয় সন্তানের জননী সামিনা মল্লিক। ইনিই সেই মানুষ, যাঁর অপেক্ষায় সারা বছর বসে থাকেন গ্রামের গরিব বাসিন্দারা। ইনি নিজেই সেই আশার মূর্ত ঝিলিক। গত ৩০ বছর ধরেই।
সামিনা হায়দ্রাবাদের মহিলা। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বাগনান থানার খাজুট্টিতে। সামিনার স্বামী মোজাম্মেল মল্লিক কুয়েতের একটি অয়েল গ্যাস সাপ্লাই কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। সামিনা নিজে সেই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। স্বামীর ব্যবসা ও নিজের কর্মসূত্রে তিনি কুয়েতেই থাকেন। কুয়েতে থাকলেও বছরে কমপক্ষে চারবার নিজের দেশে আসেন।
এই আসার উদ্দেশ্য হলো, সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়া। এইসব কাজের মধ্যে রমজানের সময়ে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা একটি দিক। এ ছাড়াও খাজুট্টি গ্রামে মহিলাদের স্বনির্ভর করার উদ্দেশে তিনি একটি সেলাই স্কুলও করেছেন। সেই স্কুলের বাছাই করা ২০জন কারিগরকে প্রতি বছর সেলাই মেশিন দিয়ে যান। একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরি করেছেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সামনে। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য অকাতরে দান করে যাচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়। কোনও গরিব মানুষের মেয়ের বিয়ে আটকে গেছে, কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন, সব সময়ে, সবার সঙ্গে, সবার পাশে এই সামিনা। সবাইকে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করে থাকেন তিনি। এ ছাড়া ১৫০ জনকে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা অসহায় ভাতা হিসেবে দিয়ে থাকেন। খাজুট্টি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি থেকে ১০০ জন দরিদ্র শিশুকে প্রতিদিন সকালে তাদের সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে দুধ সরবরাহ করা হয়।
এইসব সমাজসেবা মূলক কার্যক্রমের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট কোস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি লাভ করেছেন এমবিএ পাশ সামিনা মল্লিক। এ ছাড়া অনেক সংগঠন থেকেও তিনি নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। সামিনা মল্লিকের বাপের বাড়ি হায়দ্রাবাদে। ছোটবেলা থেকেই সামিনা সমাজসেবার নানা কাজ করতেন। প্রতিটি মেয়ের বিয়ের আগে তাঁর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে একটা কৌতূহল থাকে। সামিনারও ছিল। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সমাজসেবার কাজ করতে পারবেন তো?
হাওড়ার গ্রামাঞ্চলে বিত্তবান ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে তিনি দেখলেন, তাঁর দাদাশ্বশুর মেহের আলি মল্লিক, শ্বশুর কায়েম মল্লিক, সকলেই সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা দুজনেই প্রয়াত। সেই পরিবারের সমাজসেবার কাজ দেখে এবং নিজের আগ্রহে ও স্বামীর উৎসাহে এই সমাজসেবার পরিধি অনেক বাড়ালেন তিনি। শুধু মানুষকে আর্থিক সাহায্য নয়, পাশাপাশি মহিলাদের স্বনির্ভর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগী হলেন। এইসব কাজ দেখাশোনার জন্য কুয়েত থেকে ভারতে তাঁকে কমপক্ষে চারবার আসতে হয়। কোনও কোনও সময়ে আরও বেশি বার।
এ দিন সামিনা বলেছিলেন, ‘কুয়েতের ব্যবসায়ে ওঠানামা থাকে ঠিকই। তবে এই কাজ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেই জন্য প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে আসি দেশের মানুষের জন্য কিছু করার জন্য। যদিও জানি, দেশের এই বিরাট দারিদ্রের পাশে আমার এই ‘কিছু করা’ সিন্ধুতে বিন্দু দানের সমান। তবু আমার কাজ তো আমাকে করে যেতেই হবে।’
তাঁর পরবর্তী প্রজন্মও যাতে এই কাজ করতে পারে, সেই জন্য এই বছর কুয়েত থেকে নিজের দুই পুত্র ওসমান মল্লিক ও হোসেন মল্লিককে নিয়ে এসেছেন খাজুট্টি গ্রামে। ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কাজকর্ম বুঝে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আছেন তাঁরা।