এই সময়: তামিলনাড়ুর সমুদ্রতীরে মহাবলীপুরমের সৌধ ও মন্দিরগুলো এবং কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালকে যে ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নদীর পাড়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সম্পত্তি ও স্মৃতি রক্ষায় সেই পথ অনুসরণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার এই সংক্রান্ত মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায় দাসের ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, ‘ভাগীরথীর ভাঙন ঠেকানো কোনও ব্যাপারই নয়। মহাবলীপুরমে সমুদ্রের গায়ে থাকা বহু সৌধ বাঁচিয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সেখানে সমুদ্রের ভাঙন ঠেকানো গিয়েছে। এখন আধুনিক প্রযুক্তি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেয়। শুধু করার ইচ্ছেটা থাকতে হবে।’ এ দিন মামলার প্রাথমিক শুনানি করে হাইকোর্ট কেন্দ্রের অধীনে থাকা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্থা এবং রাজ্যের হেরিটেজ কমিশনকে আগামী সপ্তাহে সরকারের কাছ থেকে এই ব্যাপারে ‘ইতিবাচক ইনস্ট্রাকশন’ নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছে।
মুর্শিদাবাদের পর্যটনের সঙ্গে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম এক রকম সমার্থক। অথচ সেই মুর্শিদাবাদেই সিরাজের প্রায় কোনও স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নেই। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে সিরাজের গড়ে তোলা হীরাঝিল প্রাসাদ ছিল সিরাজের আমলে তৈরি অন্যতম স্থাপত্যের নিদর্শন। কিন্তু সেই প্রাসাদের একাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, অনেকটা তলিয়ে গিয়েছে ভাগীরথীতে।
যে টুকু পড়ে আছে, সে টুকু এবং তার সংলগ্ন এলাকার সংস্কার করে সংরক্ষণের দাবিতে হাইকোর্টে মামলা করেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতিরক্ষা ট্রাস্ট। এ দিন শুনানিতে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি সুমিতা সাউ জানান, ইংরেজরা নবাবের যাবতীয় স্মৃতি ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে, আর বাকিটা তলিয়ে গিয়েছে ভাগীরথীর ভাঙনে। মামলাকারী ট্রাস্টের তরফে আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও রঘুনাথ চক্রবর্তী দাবি করেন, যে ৯ বিঘা জায়গা এখনও রয়েছে, সেটা রক্ষা করা সম্ভব এবং তার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, নিজেদের ইতিহাস বাঁচাতে নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। তখনই প্রধান বিচারপতি মহাবলীপুরমের উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত, তামিলনাড়ুতে বঙ্গোপসাগরের তীরে মহাবলীপুরমে রয়েছে সপ্তম ও অষ্টম শতকে পল্লব রাজাদের আমলে তৈরি বিভিন্ন মন্দির ও সৌধ। প্রধান বিচারপতি উত্থাপন করেন কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের প্রসঙ্গও। সেখানে কী ভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের ভাঙন আটকে হেরিটেজ রক্ষা করা হয়েছে, সেটা খেয়াল করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচের কাছে স্বামী বিবেকানন্দ এক সময়ে যেখানে ছিলেন, সেই আইস হাউসের (পরে যার নাম হয় বিবেকানন্দ হাউস) কথাও।
এর মধ্যেই কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের বাস্তব উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের কী কাজ, তা নিয়ে যেমন প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, সেই সঙ্গে তাঁর জিজ্ঞাস্য, ‘রাইটার্স বিল্ডিংস নিয়ে কী রেকমেন্ড করেছে কমিশন? হাইকোর্টের এই হেরিটেজ ভবন নিয়েই বা তাদের কী পরামর্শ?’ কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘হেরিটেজের জায়গায় বড় বড় হাইরাইজ় তৈরি হচ্ছে। পুরোনো ইতিহাস রক্ষার পরিবর্তে তা ভেঙে ফেলা খুব সহজ।’ প্রধান বিচারপতির তির্যক মন্তব্য, ‘আপনি না–চাইলে এ শহরে ট্রাম থাকবে না। লাইন তুলে ফেলুন। সব মালপত্র বিক্রি করে দিন।’ প্রধান বিচারপতি মনে করিয়ে দেন, দু’টি রাজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম এসেছিল। এ রাজ্য তার মধ্যে একটা। তারা (ইংরেজরা) কিছু ভেঙেছে, কিন্তু কিছু গড়েও দিয়ে গিয়েছে। সে সব ধরে রাখার ব্যাপারে এ রাজ্যে উদ্যোগ কম বলে তিনি মনে করেন।