নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ‘ট্রমাটাইজড। ইন স্টেট অব শক। বিধ্বস্ত। কিন্তু মাথা পরিষ্কার।’ ট্যাংরা কাণ্ডে মৃত্যুর দরজা থেকে বেঁচে যাওয়া নাবালকের সঙ্গে কথা বলার পর এটাই ছিল রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া। ‘গণ আত্মহত্যা’র যে তত্ত্ব প্রণয় ও প্রসূন দে খাড়া করেছে, তাতে তিনবার চেষ্টা হয়েছে এই কিশোরকে মারার। প্রত্যেকবারই সে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে। প্রথমে ওষুধ মেশানো পায়েস খাওয়ানো, তারপর হাতের শিরা কাটার চেষ্টা, আর শেষে মুখে বালিশ চেপে ধরা। তারপরও কিশোরের নির্বিকার প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর। এন আর এস মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি আছে সে। বৃহস্পতিবার সেখানেই কথা বলতে গিয়েছিলেন শিশু কমিশনের প্রতিনিধিরা। তাঁদের সে জানিয়েছে, ‘মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল কাকা। আমি শরীরচর্চা করি। তাই অনেকক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারি। কাকা মুখে বালিশ চাপা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। ভাবে, আমি মারা গিয়েছি। কিন্তু আমি ভান করেছিলাম। কাকা বেরিয়ে যেতেই উঠে পড়ি। উপরে যাই। দেখি, বাবা আর কাকা বসে আছে। বলছে, ওরাও আত্মহত্যা করবে। বাড়িতে তখন পড়ে আছে আমার আরও তিনজন প্রিয় মানুষের দেহ... মা, কাকিমা, দিদি। কেউই যখন নেই, বেঁচে কী হবে?’
ট্যাংরার হত্যাকাণ্ডে দুই ভাইয়ের বয়ানে প্রতিদিন কোনও না কোনও অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। সবটা একত্র করে তেলের থেকে জল আলাদা করে চলেছে পুলিস। এদিনও লালবাজারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, নাবালক শরীরচর্চা করত বলে কোনও প্রমাণ তারা পায়নি। বরং প্রণয় ও প্রসূনের জিম-ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্যাক্ট সুইসাইডের প্ল্যান করার পরই বাড়ির ভিতরের সব সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়েছিল প্রণয়-প্রসূন। তাই ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে কোনও ফুটেজ নেই। প্রথমে পায়েস, তারপর হাতের শিরা কেটে ফেলা। এই ছিল মূল প্ল্যান। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রিয়ংবদাকেও পায়েস খাওয়ানোর পর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মারা হয়েছিল। আর সেটা ১৭ তারিখ রাতেই। পরের দিন আচ্ছন্ন সুদেষ্ণা ও রোমিকে হাতের শিরা কেটে। এখন আবার প্রসূন দাবি করছে, দুই বউ নিজেরাই নিজেদের শিরা কেটেছে। প্রণয় বলছে, সে কিছু দেখেনি। তাহলে সত্যিটা কী? এই উত্তর খুঁজে চলেছে পুলিস। বালিশ চাপা দেওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যাওয়ার পর সেদিন উপরে গিয়ে বাবা-কাকাকে কিশোর প্রশ্ন করেছিল, ‘কেন এমন করলে?’ কমিশনের কাছে সেকথা জানিয়েছে নাবালক। বলেছে, বাবা-কাকা তাকে ব্যবসায় মন্দা, পাওনাদারের কথা জানিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, তাকেও আত্মহত্যা করতে হবে। কারণ, যে লাইফস্টাইলে তারা বড় হয়েছে, তাতে পরবর্তী কঠিন সময় সে সামলাতে পারবে না। ঘটনার আগের দিন যখন সে প্রশ্ন করেছিল, মা সুদেষ্ণা বলেছিলেন, ‘বড়দের ব্যাপার। তোমাকে জানতে হবে না।’ অথচ ব্যবসা খারাপ চলছে, বাবা-মা-কাকা ও কাকিমার মধ্যে আলোচনা চলছে, সবটাই জানুয়ারি থেকে জানত সে। মা সুদেষ্ণা বলতেন। ঘটনার দিন দশেক পর এহেন নির্লিপ্ত বয়ানে অবাক অনন্যাদেবী।
আর দু’-একদিনেই প্রণয়-প্রসূনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে। কিন্তু ওই কিশোরের কী হবে? অনন্যাদেবী বলেন, ‘প্রসূন দে’র শ্বশুর-শাশুড়িকে অনুরোধ করা হবে, সুস্থ হওয়ার পর যাতে ওর দায়িত্ব নেন। এই সংক্রান্ত রাজ্যের প্রকল্প আছে। মাসে মাসে টাকা দেওয়া হবে। যদি তাঁরা রাজি না হন, এক দম্পতি আছেন।’ অনন্যাদেবী বলছিলেন, ‘ওর চোখে এক ফোঁটা জল নেই! না কাঁদলে ও যে পাগল হয়ে যাবে! দাবা খেলতে ভালোবাসে। একটা দাবার বোর্ড আর রবি ঠাকুরের ছেলেবেলার বই দিয়ে এসেছি। নেতাজি পড়ছে। দেখা যাক!’