দিব্যেন্দু সিনহা, জলপাইগুড়ি
এলাকায় কোনও মুসলিম পরিবার নেই। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকেনি পাগলা বাবার মাজারের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারকাজ। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে মোমবাতি জ্বলে। রঙের প্রলেপ পড়ে মাঝেমধ্যেই। দীর্ঘদিন ধরে সেই মাজার দেখভাল করে আসছেন হিন্দুরাই। হিন্দু পরিবারের বিয়ের পর নবদম্পতি এই মাজারে প্রদীপ জ্বালিয়ে তবেই বাড়ি ঢোকেন।
দীপাবলির রাতে আলোয় সেজে উঠে এই মাজার। সমস্ত দায়িত্বই সামলান হিন্দু ধর্মালম্বীরা। জলপাইগুড়ি শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি এলাকায় রয়েছে পীর বাবার মাজার। স্থানীয়দের কাছে এই পীর বাবা পাগলা বাবা নামেই পরিচিত। তাঁর উপরে এলাকার হিন্দুদেরও অগাধ বিশ্বাস।
স্থানীয়রা বলেন, ‘ধর্মের বিভেদ মানে না পাগলা বাবা। যে কেউ আসতে পারেন তাঁর কাছে।’ কিন্তু কবে, কী ভাবে গড়ে ওঠে ওই মাজার? তার সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, হলদিবাড়ির হুজুর সাহেব এবং জলপাইগুড়ির কালু সাহেবের আমলে একজন মুসলিম ফকির এসেছিলেন এই এলাকায়। তাঁর প্রকৃত নাম জানা না গেলেও তাঁকে পাগলা বাবা বলেই ডাকা হতো। মানুষের সেবায় ও উপকারে নিজেকে অর্পণ করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরে যে জায়গায় তাঁকে সমাধীস্থ করা হয় সেটিই বর্তমানে পাগলা বাবার মাজার বলে পরিচিত।
মাজারটি রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ সুত্রধরের বাড়ির পাশেই। সন্তোষের মেয়ে, বুলিবুলির কথায়, ‘নিয়োম করে প্রতি সন্ধ্যায় মাজারে মোমবাতি আর ধুপ জ্বালাই। শুধু আমিই নই, পাড়ার অনেকেই আসেন এখানে বাতি জ্বালাতে। কেউ কেউ শুভকাজে যাওয়ার আগে মাজারে এসে প্রণাম করে যান।’ এই সম্প্রীতির ছবি দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন সুমিতা মিশ্র। তিনি জানালেন, এলাকার মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস রয়েছে, এই মাজারে কোনও মানত করা হলে তা ফল পান তাঁরা।
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অশিতিপর গোবিন্দলাল রায় বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মাজারটি এই ভাবেই দেখে আসছি। বাবার মুখে শুনেছি, আগে এখানে বেশ কয়েকটি মুসলিম পরিবারের বাস ছিল। কিন্তু ১৯৫০–এর দাঙ্গার পরে এখান থেকে তারা অন্যত্র চলে যায়। তারও বহু আগের থেকেই রয়েছে এই মাজার।’ বর্তমানে সেখানে কোনও ইসলাম ধর্মাবলম্বী পরিবার না থাকায় মাজারটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন হিন্দুরাই।
পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি নবীনসঙ্ঘ ও পাঠাগারের সম্পাদক অভিজিৎ দাসের বক্তব্য, ‘বছরভর ওই মাজারে স্থানীয়রা আসা–যাওয়া করলেও প্রতি শুক্রবার সেখানে অন্যান্য এলাকা থেকে মুসলিম মানুষজন এসে বাতি জ্বালিয়ে যান। সেখানে সব থেকে বেশি ভিড় হয় হলদিবাড়ির হুজুর সাহেবের মেলার দিন। সেই মেলা দেখে ফেবার সময়ে বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই পাগলা বাবার মাজারে মোমবাতি জ্বালিয়ে যান।
স্থানীয় ক্লাবের তরফেই করা হয় মাজারের সংস্কারকাজ। প্রতিবছর কালীপুজোর আগে মাজারে রং করা হয়। এ বিষয়ে জলপাইগুড়ি শহরের কালু সাহেব মসজিদের ইমাম মহম্মদ নসিবুল বলেন, ‘পাগলা বাবার মাজার দীর্ঘ বছর ধরে হিন্দুরাই রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন। তাই আমরা আর তাতে হস্তক্ষেপ করি না। এই ব্যতিক্রম সমাজের নজির হয়ে রয়ে যাক, এটাই চাই।’