অভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কাটোয়া
সম্ভ্রান্ত পরিবার। কিন্তু স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে দেওয়ার মতো সময় নেই বাবা–মায়ের কাছে। এক জন্মদিনে ছেলেকে দামী মোবাইল উপহার দেন বাবা–মা। একাকিত্ব কাটাতে মোবাইল সঙ্গী হয় ওই কিশোরের। মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে শুরু হয় গোলাগুলির শুটিং গেমের প্রতি আসক্তি। কিশোর–মনে ক্রমে প্রভাব পড়তে থাকে সেই গেমের। হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে সে। নিজেকে মেরে ফেলার চেষ্টা পর্যন্ত করে।
শেষপর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয় শিশুর বাবা–মাকে। বাংলা সিনেমা ‘হাবজি গাবজি’র এই চিত্রনাট্যই যেন দেখা গেল কাটোয়ায়। যদিও ছেলের জেদের কাছে এখানে অসহায় দরিদ্র বাবা–মা।
রাতদিন মোবাইলেই ডুবে থাকত। সব কাজ ফেলে চলত অনলাইনে গেম খেলা। গেম খেলার এই আসক্তি থেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে কাটোয়া শহরের এক কিশোর। বুধবার রাতে তাকে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অস্বাভাবিক আচরণ করছিল ওই কিশোর। বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিল সে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও শুধু একটা কথাই বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আমাকে মেরে দেবে। আমাকে ওরা বাঁচতে দেবে না।’ কিশোরের এই অবস্থায় রীতিমতো চিন্তিত পরিবারের লোকজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের সুপার বিপ্লব মণ্ডল বলেন, ‘ওই কিশোর অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তাকে সাইক্রিয়াটিক বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটা চিন্তার বিষয়। এ ধরনের গেম খেল মনের উপর প্রভাব ফেলা অস্বাভাবিক নয়। অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই কিশোর সপ্তম শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে৷ সেটাও শুধু গেমের নেশার কারণে বলেই পরিবারের দাবি৷ গেমের নেশা এতটাই বেড়ে যায় যে, রিকশাচালক বাবাকে দামী মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য চাপ দিত। বাবা মোবাইল কিনে দিতে অসমর্থ হওয়ায় নিজেই ফলের দোকানে কাজ করে মোবাইল কেনে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু ফ্রি ফায়ার গেম খেলে যেত। রাত জেগে খেলতে গিয়ে সে বেশ কয়েক বার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবুও সেই গেম খেলা বন্ধ করেনি। শেষে বুধবার রাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় তড়িঘড়ি তার বাবা–মা তাকে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে। ওই কিশোরের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ছেলেটা আমার শুধু গেমের নেশায় শেষ হয়ে গেল। অনেক বলেও ওর গেম খেলা ছাড়াতে পারিনি।’
কয়েকদিন আগেই মহারাষ্ট্রের ভাইওয়াদায় বছর ১৪-র এক কিশোরকে পরিবারের লোকজন ‘ফ্রি ফায়ার’ খেলতে না দেওয়ায় সে অভিমানে আত্মঘাতী হয়। এ সব গেম কিশোরদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেই মত চিকিৎসকদের। ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির (আইওপি) প্রাক্তন অধিকর্তা প্রদীপ সাহার বক্তব্য, ‘এমন ছেলে-মেয়েরা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার (ওএসডি) কিংবা পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত। চিকিৎসায় দেরি হলে এদের ভবিষ্যতটাই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে৷’ তিনি জানান, মাদক, তামাক, মদ ইত্যাদিতে আসক্ত রোগীর ভিড়ে বছর পাঁচেক আগে থেকেই নয়া সংযোজন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল স্মার্টফোন-নেট-পর্নো এবং গেমিং অ্যাডিকশন। ইদানিং এই সংখ্যাটা ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছে।
আর এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের পরামর্শ, ‘ছেলে-মেয়ে কোন গ্রুপে মিশছে, নতুন কোনও বন্ধুবান্ধব বা গ্রুপের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ জন্মাচ্ছে কি না, একা ঘরে থাকতে সে হঠাৎ করে পছন্দ করছে কি না, ভিতর থেকে ঘর বন্ধ করে রাখার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে কি না, লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা বা সকাল-সকাল ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা কমে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মায়েদের।’ তিনি জানান, ধারাবাহিক ভাবে পড়াশোনায় মনোযোগ বিঘ্নিত হওয়া কিংবা ক্লাস করতে অনীহা দেখতে পেলে, অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে হবে অভিভাবককে। দেখতে হবে, সন্তানের মধ্য আচমকা ক্রোধ অথবা দিনে ঘুমোনোর প্রবণতা দেখা দিচ্ছে কিনা, তাও
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, মূল চিকিৎসা হলো বিহেভেরিয়াল থেরাপি। এর অঙ্গ কাউন্সেলিং আর ওষুধ৷ মূলত অ্যান্টি-অবসেসিভ ড্রাগ দেওয়া হয় যাতে শরীরে সেরোটোনিন হরমোন ক্ষরণ বাড়ে এবং ডোপামিন হরমোন ক্ষরণ কমে৷ কারণ, এই দু’টি হরমোনই যথাক্রমে কমে ও বেড়ে যায় মোবাইল-নেট আসক্তদের শরীরে।