এই সময়, শিলিগুড়ি: সালটা ২০১৫। পুর নির্বাচন চলছে। লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকশো ভোটার। আচমকা দেখা গেল, সকলের পায়ের নীচের মাটি কাঁপছে। কাঁপুনির কারণ যে ভূমিকম্প, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়দৌড়ি শুরু হল। আতঙ্ক, উত্তেজনা থিতু হতে দেখা গেল, শহরের বেশ কয়েকটি বহুতলে ফাটল দেখা দিয়েছে। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, কতটা নিরাপদ এই বহুতলে বসবাস। বৃহস্পতিবার গভীর রাতের ভূমিকম্প আবার সেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে শিলিগুড়ির বাসিন্দাদের।
২০১৫ সালই অবশ্য প্রথম নয়। তার আগে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে দিন ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। আচমকা ভূমিকম্পে মানুষজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে কারও কারও পা ভাঙে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেউ দোতলা থেকে লাফ দিতে গিয়ে জখম হন। বৃহস্পতিবারের ভূকম্পে তেমন কোনও ঘটনা সামনে আসেনি বটে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বড় মাপের ভূমিকম্প হলে শিলিগুড়ির কপালে অশেষ দুঃখ রয়েছে। যত্রতত্র গড়ে ওঠা বহুতল রয়েছে এই আশঙ্কার মূলে।
পুর আইনে চারতলার বেশি উঁচু বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু এই আইন তৈরির আগেই বেশ কিছু বহুতল তৈরি হয়েছে শহরে। আইন তৈরির পরেও তার ফাঁক গলে তৈরি হয়েছে বহুতল। এমনকী, শিলিগুড়ি লাগোয়া পাথরঘাটা, আঠারোখাই, মাটিগাড়া-১, ডাবগ্রাম-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে একের পর এক বহুতল গড়ে উঠেছে। অভিযোগ, পঞ্চায়েত এলাকার বহুতলের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সয়েল টেস্টিং’ ঠিক মতো করা হয়নি। প্রশাসনও চোখ বুজে ছিল। ফলে আশঙ্কা, বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হলে বহুতল বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না তো!
কেবল শিলিগুড়িই নয়, বহুতল তৈরির প্রবণতা এখন পাহাড়েও। দার্জিলিং ম্যালের আশপাশে একের পর এক বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিংয়ে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরির প্রবণতা দেখে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এই মতে সিলমোহর দিয়ে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের গ্যাংটক শাখার অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলায় বহুতল তৈরি করা উচিত নয়। এই এলাকাগুলি ভূমিকম্পপ্রবণ। বড় মাপের ভূমিকম্প হলে দুর্ভোগে পড়তে হবে এখানকার বাসিন্দাদেরই।’ দার্জিলিং পুরসভার ক্ষমতা হাতে পেয়ে হামরো পার্টির নেতা অজয় এডওয়ার্ডস বেআইনি সমস্ত ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে তাঁর দলকেই পুরসভার ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে দেওয়া হয়।
অথচ ২০২৪ সালের অক্টোবরে সিকিমে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, সেটা বুঝিয়ে দেয়, পাহাড়ে ভূমিকম্পজনিত বিপর্যয় ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে। সে দিন সাউথ লোনার্ক হ্রদের বাঁধ ভাঙার আগে লাগোয়া নেপালে টানা ১০ বার মাঝারি মাপের ভূমিকম্প হয়। এতগুলি ভূমিকম্পের জেরে হিমবাহ গলা জল ধরে রাখতে পারেনি সাউথ লোনার্ক হ্রদের বাঁধ। এর ফলে সিকিম রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়।
ফের ভূমিকম্প হলে বিপর্যয়ের ভয় রয়েছে তিস্তা নদীর উপরে তৈরি এ সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে। সেবক-রংপো রেল প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও এ জন্যই বার বার প্রশ্ন ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ে বার বার ধসের কারণও এই ভূমিকম্প। মাঝারি মাপের ভূমিকম্পে প্রাণহানি না-ঘটলেও পাহাড়ের পাথরের গায়ে ফাটল ধরছে। বর্ষায় এই সমস্ত ফাটল গলে জল জমছে। তার পরে ধস নামছে। পাহাড়ে যদি ফাটল ধরে, তা হলে বহুতলের কী পরিণতি হতে পারে!