দিব্যেন্দু সরকার, আরামবাগ
একুশ শতকীয় সমাজের নতুন প্রবণতা ডিভোর্স। সাদা বাংলায় বিবাহবিচ্ছেদ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা সেই বিচ্ছেদ এমন এক গভীর ক্ষত তৈরি করছে, যা থেকে মুক্তি কী ভাবে মিলতে পারে, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল সকলে।
শহুরে জীবনের জটিলতার কথা বাদ–ই দেওয়া যাক। আরামবাগের মতো শান্ত জনপদে সেই সঙ্কটের ছবি দেখলে আঁতকেই উঠতে হয়। প্রতিদিন আরামবাগ মহকুমা আদালতে উঁকি দিলে দেখা যায়, কালো কোটধারী উকিলদের ব্যস্ততা। হাতে কাগজপত্র নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মুখের সারি। কখনও তা কোনও মহিলার, কখনও বা পুরুয়ের। কোথাও আবার দম্পতি। সমস্ত সম্পর্কের আগল ছিঁড়ে ফেলে যারা হয়তো ‘মুক্তি’র খোঁজ করছেন!
সত্যি–ই কী মুক্তি মেলে! আইনজীবী থেকে পুলিশ আধিকারিক, বিচ্ছেদের প্রশ্ন ছুড়ে দিলে তাঁরাও নির্বাক হয়ে পড়েন। চোখেমুখে ফুটে ওঠে দুর্বোধ্য প্রশ্নাবলির আঁকিবুঁকি। উত্তর তাঁদেরও জানা নেই। হাতের কাছেই রয়েছে আরামবাগ মহকুমা আদালতের উদাহরণ। নিয়ম করে প্রত্যেকদিন সেখানে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা। অধিকাংশই দম্পতি। একে অন্যের থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য নিচ্ছেন আইনের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক।
২০১৮ সালে শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিয়েছিল, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অপরাধ নয়। সেই সম্পর্কের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে কিন্তু তার জন্য কোনও পুরুষ অথবা নারী–কে অপরাধী হিসেবে দেগে দেওয়া যাবে না। এটা তো আইনি ভাষা, কিন্তু দাম্পত্য কী সেই আইনের ভাষা মেনে চলতে পারে? বাস্তবের ছবিটা বলছে, দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্কের দেওয়ালে দ্বিতীয় কোনও অযাচিত পুরুষ অথবা মহিলার উপস্থিতি এমন ফাটল তৈরি করে দিচ্ছে, যা কোনও ভাবেই মেরামত করা সম্ভব নয়। তা হলে সমাধান? আইনি জটিল চক্র অতিক্রম করে বিবাহবিচ্ছেদের পথে হাঁটাই শ্রেয়!
আরামবাগ মহকুমা আদালতের ছবিটাই দেখা যাক। আরামবাগ মহকুমা আদালতে ২০২০ সাল পর্যন্ত বছরে দু’শোর মতো ডিভোর্স মামলা হতো। এখন সেই সংখ্যাটা লাফিয়ে বেড়েছে বছরে ৩০০–এরও উপরে। প্রতি মাসে গড় মামলার সংখ্যাও আগের চেয়ে বাড়ছে। বিয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন এখন বাধ্যতামূলক হয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বিবাহবিচ্ছেদের মামলার ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্র দেখে তাজ্জব আইনজ্ঞরাই। সোশ্যাল ও স্পেশ্যাল ম্যারেজ আইনে বিচ্ছেদের মামলা এলেই কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিসংখ্যানে উঠে আসেছে অল্পবয়সীদের স্পেশ্যাল ম্যারেজ আইনে বিয়ে ও দ্রুত তা ভেঙে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তারা আদালতে এসে বিচ্ছেদের কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। আইনজীবীদের একাংশের মত, একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া এবং থাকার ছাড়পত্র হিসেবে ম্যারেজ সার্টিফিকেটকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
মহকুমা আদালতে এক সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য, ‘গত পাঁচ বছরে দু’টো বিষয় নজরে আসছে। আগে বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রাধান্য থাকত। এখন তার সঙ্গে জুড়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। দ্বিতীয় ব্যাপারটি আরও উদ্বেগজনক। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের স্পেশাল ম্যারেজ আইনে বিবাহ ও খুব দ্রুত বিচ্ছেদের মামলা ঘটছে। এখানে একশোটি বিচ্ছেদের মামলার মধ্যে ২০ শতাংশ মামলার কারণই এই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। অনেক ক্ষেত্রে আবার ছেলে অথবা মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকেই বিচ্ছেদ নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা আরও বিপজ্জনক। মননা চাইলেও আমাদের সেই মামলার নিষ্পত্তি করতে হয়।’
আরামবাগ বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অনুপ কুমার দে–র বক্তব্য, ‘পারিবারিক সচেতনতার অভাবে এটা আরও বেড়েছে। ভয়ঙ্কর সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসন কমবয়েসি ছেলেমেয়েদের এমন এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে যে, তারা সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে ভাবার প্রয়োজনই অনুভব করছে না। আমরাও নিজেদের মতো করে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু সেটা তো যথেষ্ট নয়। পরিবারের সদস্যদের সচেতনতাও প্রয়োজন।’ সমাজকর্মী দোলন দাসের ব্যাখ্যা, ‘সাধারণ ভাবে শিক্ষার অভাব এই প্রবণতা আরও বাড়িয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও তো সঙ্কট থেকে মুক্ত নয়। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।’
সঙ্কটের শেষ কোথায়? কী তার সমাধান? উত্তরটা এখনও অজানা–ই!