• কলকাতার কড়চা: সারা জীবনের কাজ
    আনন্দবাজার | ০১ মার্চ ২০২৫
  • ছবি আঁকতেন তিনি। আর সেই সব ছবির পট জুড়ে কী উৎফুল্ল রঙের ফোয়ারা! গোপাল ঘোষ আর এই দু’টি শব্দ— ‘উৎফুল্ল রং’— একপ্রকার সমার্থকই বলা যায়।

    এ শহরেই, ১৯১৩-র ৫ ডিসেম্বর গোপাল ঘোষের জন্ম। পিতা ছিলেন মিলিটারি ক্যাপ্টেন, তাঁর চাকরির সুবাদে ছেলেবেলা কেটেছে শিমলায়। পিতা বদলি হয়েছেন নানা জায়গায়, পুত্রেরও সেই সূত্রে পথ পরিক্রমা। আর গড়ে উঠছিল দেখার মন, অনুসন্ধানের চোখ। ম্যাট্রিক পাশ করেন এলাহাবাদে থাকাকালীন, সেখানেই আইএ-র পাঠ শুরু, অচিরেই অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। বিতাড়িত হলেন কলেজ থেকে। অতঃপর জয়পুর মহারাজা আর্ট স্কুলে শুরু শিল্পশিক্ষা।

    সেখানকার উপাধ্যক্ষ তখন অবনীন্দ্রনাথের শিল্পপথের আলোয় আলোকিত শৈলেন্দ্রনাথ দে। তাঁর কাছে বঙ্গীয় শিল্পশিক্ষার পাঠ নেন গোপাল ঘোষ, কলেজের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর টানে মাদ্রাজের গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে, সেখানেও চিত্রকলা বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন তিনি। এর পর নতুন এক ভুবন পরিক্রমা, সাইকেল সঙ্গী করে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ফেরার পর ১৯৩৮-এ থিতু হন কলকাতায়, বঙ্গশ্রী পত্রিকায় প্রকাশ পায় তাঁর সচিত্র ভ্রমণকাহিনি। রসিকমহলের সমাদর লাভের সেই সূত্রপাত। অতঃপর স্কটিশ চার্চ কলেজ ও শিবপুর বি ই কলেজে কিছু দিন কর্মজীবন কাটিয়ে অবনীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় ওরিয়েন্টাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ান আর্ট-এ শিক্ষকতায় যোগদান। সেখান থেকেই তাঁকে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে নিয়ে আসেন অধ্যক্ষ রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

    পরবর্তী সময়ে বঙ্গীয় চিত্রকলা পল্লবিত হয়েছে যাঁদের হাতে, সেই গণেশ হালুই লালুপ্রসাদ সাউ যোগেন চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীর গড়ে ওঠার পথে ‘মাস্টারমশাই’ গোপাল ঘোষের ভূমিকা স্মরণীয়। আর্ট কলেজের ক্লাসরুমেই তিনি বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের মতো করে এক স্টুডিয়ো। ছাত্রছাত্রীদের মাঝেই নিজেকে কাজে মগ্ন রাখতেন— জলরঙে অলৌকিক প্যাস্টেলের প্রগাঢ় মিলন ঘটাতেন তিনি। আর আর্ট কলেজের বাগানে শুয়ে শুয়ে কেবলই ফুল দেখা, ফুল দেখতে দেখতে নিজেই ‘আগুনের ফুল’ হয়ে ওঠা।

    আলিপুর মিউজ়িয়মে দিল্লি আর্ট গ্যালারির (ডিএজি)-র নিবেদনে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে গোপাল ঘোষের শতাধিক কাজ নিয়ে চিত্রপ্রদর্শনী ‘ফ্লাওয়ার অব ফায়ার: দ্য লাইফ অ্যান্ড আর্ট অব গোপাল ঘোষ’। চলবে ২৩ মার্চ অবধি, সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা। পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত প্রদর্শনীর ছবিগুলি: ‘লাইফ অ্যান্ড স্টিল লাইফ’, ‘ফ্লোরাল ট্রিবিউটস’, ‘কালারস অব দ্য আর্থ’, ‘মেডিটেশন অন মোনোটোন’ এবং ‘রেখা অ্যান্ড আদার আর্লি ওয়ার্কস’ (উপরে ও মাঝের ছবিতে তা থেকেই কয়েকটি চিত্রকৃতি, নানা সময়ের কাজ)। গোপাল ঘোষের মতো এক বর্ণময় ব্যক্তিজীবন এবং শিল্পীজীবনকে বুঝতে এই ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’ প্রদর্শনী যারপরনাই কাজে দেবে সমঝদার থেকে সাধারণ শিল্পাগ্রহী, সকলেরই।

    পাশ্চাত্যের নানা দেশে নারীশিক্ষার অগ্রগতি ও পরে জাপান যাত্রার অভিজ্ঞতা লেডি অবলা বসুকে (ছবি) উদ্বুদ্ধ করেছিল এ দেশে নারীশিক্ষা বিস্তারে। প্রান্তিক প্রাপ্তবয়স্কা নারী, বিশেষত বিধবা ও স্বামীবিচ্ছিন্নারা যাতে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন সেই লক্ষ্যে তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘নারী শিক্ষা সমিতি’র শুরু ১৯১৯ সালে। সমিতির স্মারক ভারতমাতা এঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি ধাত্রীবিদ্যা, তাঁতের কাজ, সেলাই ও অন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে মেয়েরা যাতে নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদন নিজেরাই করেন, সেই লক্ষ্যে সমিতির ছত্রছায়ায় জন্ম নেয় বিদ্যাসাগর বাণীভবন বিধবা আশ্রম, মহিলা শিল্প ভবনের মতো প্রতিষ্ঠান। ১৯২৬-এ শুরু হওয়া মহিলা শিল্প ভবন এ শহরের প্রথম অবৈতনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র। একশো বছর ছুঁল অবলা বসুর সেই উদ্যোগ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুস্তিকা প্রকাশ, প্রদর্শনীতে শুরু হল শতবর্ষ উদ্‌যাপন।

    গ্রীষ্মের ছুটির দুপুর কেটে যেত জুল ভার্নের উপন্যাসের রুদ্ধশ্বাস পাঠে— তর্জমাকার মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আশির দশকের গোড়া। অজানতেই তর্জমার এক জরুরি প্রাথমিক শর্ত মনে ঢুকে গিয়েছিল: তর্জমা পড়ে, তর্জমা পড়ছি মনে হলে সে খুব কাজের নয়। ২০০৭-৮ নাগাদ নীলাঞ্জন হাজরার পরিচয় মানববাবুর সঙ্গে, ওঁর প্রয়াণাবধি যে সম্পর্ক ছিল অন্তরঙ্গ নৈকট্যের। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-সহ আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক উর্দু কবিদের তর্জমাকার নীলাঞ্জনই ‘মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বৈঠক ২০২৫’-এর প্রধান বক্তা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের আয়োজন, ৭ মার্চ বিকেল ৪টেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধদেব বসু সভাঘরে, বিষয় ‘তরজমা: অনিবার্য বিশ্বাসঘাতকের অবিচল দায়বদ্ধতা’।

    মঞ্চে সুপ্রিয় ও ক্ষেম‌ংকর। সুপ্রিয় প্রাণময় উচ্চারণে বলছেন, “ক্ষেমংকর, তুমি দিবে প্রাণ—/ আমার ধর্মের লাগি করিয়াছি দান/ প্রাণের অধিক প্রিয় তোমার প্রণয়,/ তোমার বিশ্বাস।” প্রায় চল্লিশ বছর আগে কলকাতাকে মালিনী নাট্য-উপহার দিয়েছিলেন কুমার রায়। শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী’র দায়িত্ব তখন তিনিই বইছেন, বইবেন আমৃত্যু। মালিনী নাটকের সে দিনের সুপ্রিয় সৌমিত্র বসু ও ক্ষেমংকর দেবেশ রায়চৌধুরী তাঁর নির্দেশনায় একের পর এক নাটকে গড়েছেন নিজস্ব অভিনয়শৈলী। ২ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে বহুরূপী ও কুমার রায় স্মৃতি রক্ষা সমিতির উদ্যোগে তাঁর স্মৃতিতে আয়োজিত দ্বাদশ বর্ষ নাট্য বক্তৃতামালায় এ বারের বক্তা সৌমিত্র বসু, বলবেন ‘অভিনয়শৈলী নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ’। চিত্রা সেন ভূষিত হবেন কুমার রায় স্মৃতি সম্মানে।

    উদ্বোধনী সন্ধ্যায় একক অভিনয়ে সীমা বিশ্বাস, নতুন ভাবে স্ত্রীর পত্র। ‘পূর্ব-পশ্চিম’ নাট্যগোষ্ঠীর নাট্যোৎসব অ্যাকাডেমি মঞ্চে ৬-৯ মার্চ, উদ্বোধনে মোহন আগাসে, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার পাবেন সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত। দুই নতুন প্রযোজনা উৎসবে: দিব্যেন্দু পালের নির্দেশনায় ‘আন্তরিক’ নাট্যগোষ্ঠীর বাবুজনা দুই, অভিনয়ে দেবশঙ্কর হালদার ও মানসী সিংহ। আর ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত, ‘উষ্ণিক’-এর শ্রাদ্ধ শতবার্ষিকী, অভিনয়ে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে আয়োজক নাট্যগোষ্ঠীর জোছনাকুমারী, শ্রী ও নিধুবাবু কথা, সরীসৃপ, এক মঞ্চ এক জীবন ইত্যাদি। কর্ণধার সৌমিত্র মিত্র জানালেন, উৎসবে শতবর্ষের শ্রদ্ধা তৃপ্তি মিত্র বাদল সরকার ও তাপস সেনকে; ওঁদের নিয়ে বলবেন দেবাশিস মজুমদার রজত দাস ও সুদীপ সান্যাল।

    অষ্টাদশ শতকের যুগসন্ধিতে এক তোলপাড়ের সময় রামপ্রসাদ সেনের উত্তরণ এক জিজ্ঞাসু সত্যসাধকে। সাধক কবিকে ঘিরে যে নানা কিংবদন্তি, তাতে কি ধরা পড়ে ব্যক্তি মানুষের দ্বন্দ্ব? তা বরং আছে ওঁর গানে: সাধন ও জীবনের রহস্য-উদ্ঘাটন চেষ্টায়। রামপ্রসাদি গানে বিধৃত দু’টি দিক, সমন্বয় সাধন ও মাতৃরূপকল্পনা— বঙ্গজীবনেও যা প্রভাব ফেলেছে উত্তরকালে। প্রাচীন ‘কথা’ আঙ্গিকে এক পরিবেশনায় তা-ই খুঁজেছেন আশিস ঘোষ। দিল্লিবাসী এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দীর্ঘকাল জড়িয়ে নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার ও পারফর্মিং আর্টের সঙ্গে, এ বার কলকাতায় ওঁর নিবেদন ‘রামপ্রসাদের সন্ধানে’। ৩ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্কের বিবেকানন্দ হল-এ; পরদিন সন্তোষপুরের অনুচিন্তন ব্ল্যাক বক্স-এ, সন্ধে সাড়ে ৬টায়।

    অমোল পালেকর কলকাতায় আসছেন, সুখবর শহরবাসীর কাছে। শতবার্ষিকী উপলক্ষে বলবেন তপন সিংহকে নিয়ে, ওঁর আদমি অউর অওরত-এ স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর অভিনয়। ৬ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যোগেন চৌধুরীর উপস্থিতিতে গ্যালারি চারুবাসনায় বক্তৃতার পাশাপাশি অমোল উদ্বোধন করবেন মেলোডি অব মুভি/তপন সিংহ (প্রকা: তপন সিংহ ফাউন্ডেশন) বইটিও। মুখবন্ধ তনুজার, আছে অশোককুমার দিলীপকুমার বৈজয়ন্তীমালা শর্মিলা ঠাকুর শাবানা আজমি দীপ্তি নাভাল রবিশঙ্করের লেখা; সঙ্গে এ শহরের নক্ষত্ররাও: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপর্ণা সেন নির্মলকুমার ভারতীদেবী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গৌতম ঘোষ। ছবিতে অভিমন্যু সিনেমার সাউন্ড রেকর্ডিংয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তপন সিংহ ও অলোকনাথ দে-র সঙ্গে অমোল।

    নয়ছয় বলতে বাঙালি যা বোঝে, ‘আমরা নয়ছয়’ অবশ্য বোঝে ও বোঝাতে চায় তার উল্টোটা। ‘নয়ছয়’ ওদের কাছে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্রজীবনে ফেলে আসা সোনালি দিনের উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন। নয় আর ছয় পাশাপাশি রাখলে হয় ছিয়ানব্বই, ১৯৯৬ সালে পাশ করে বেরোনো আর্ট কলেজের প্রাক্তনীরাই পরে গড়েছেন ওঁদের ব্যাচের শিল্পীগোষ্ঠী ‘আমরা নয়ছয়’। প্রায় ত্রিশ বছর হতে চলল প্রিয় প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার, চিত্রকলা ভাস্কর্য-সহ নানা মাধ্যম ও আঙ্গিকের শিল্পচর্চা কিন্তু ওঁরা বজায় রেখেছেন। গত ছ’বছর ধরে বার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীতে নিজেদের সাম্প্রতিক শিল্পকৃতি (ছবিতে একটি) তুলে ধরেন ওঁরা, সপ্তম বছরের প্রদর্শনী আগামী ৩ থেকে ৯ মার্চ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে, রোজ দুপুর ১২টা-রাত ৮টা। সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টায় উদ্বোধন, থাকবেন সমীর আইচ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন এবং শিল্পোৎসাহীরা।

    সব সন্ধানীর সদা সহায় তিনি। উত্তর কলকাতার লক্ষ্মীনারায়ণ মুখার্জি লেনের তেতলা বাড়ির চিলেকোঠার ঘরেই প্রায় গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া দেবপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় তথা অশোক উপাধ্যায়ের সহায়তা যে দুই বঙ্গের কত গবেষক পেয়েছেন, ইয়ত্তা নেই তার। তথ্যপঞ্জি নির্মাণ করেছেন জীবনভর, সেরা কাজ বাংলা সাময়িকপত্রে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চা পথিকৃৎ প্রবন্ধপঞ্জি ও সাময়িকপত্রে বঙ্গদেশচর্চা। অনাড়ম্বর যাপনে অভ্যস্ত, জ্ঞানচর্চায় খুঁতখুঁতে মানুষটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাঠকক্ষেই কাটিয়েছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়, প্রয়াত ২০২৩-এর ২১ নভেম্বর। তাঁর স্মরণে ‘গ্রাম-জনপদ’ আয়োজন করেছে স্মারক বক্তৃতা, আজ বিকেল ৫টায় মহাবোধি সোসাইটিতে। বলবেন কলকাতা-গবেষক দেবাশিস বসু; স্মৃতিচারণে ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী ও অরিন্দম দাশগুপ্ত। অশোক উপাধ্যায়কে উৎসর্গীকৃত বই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়: সৃজনে ও স্মরণে (আশাদীপ) প্রকাশ পাবে।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)