• এই তো জানু পেতে বসেছি, সেই বসন্ত আর এই বসন্ত
    আনন্দবাজার | ০২ মার্চ ২০২৫
  • মধ্য ফেব্রুয়ারির বসন্ত বিকেলে রবীন্দ্রসদন চত্বরে গুপুস-গুপুস করে তোপধ্বনি হচ্ছিল। অনুচ্চ এক বেদির উপর ফুলে-মালায় সজ্জিত তাঁর নশ্বর শরীর। অদূরে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও কয়েক জন মন্ত্রী। আর তাঁর পরিজনেরা এবং কিছু সাধারণ মানুষ। একুশ তোপধ্বনি-সঞ্জাত রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পরে তাঁর ছোটখাটো দেহটি চলে যাবে রাস্তার ও পারে এসএসকেএম হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগে। যে হাসপাতালের রোগশয্যায় কেটে গেল তাঁর বিরাশি বছরের জীবনের শেষ দিনগুলো। ডাক্তারির পড়ুয়াদের সাহায্যার্থে দেহদান করে গিয়েছেন তিনি।

    প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অন্তিমযাত্রা দেখতে দেখতে প্রায় চল্লিশ বছর আগের দিনটা মনে পড়ে গেল। সে-ও এমনই এক বসন্তকাল। কালও নয়, ঘোর বসন্ত! দোল।

    উল্টোডাঙার সরকারি আবাসনে রং খেলার হিড়িক পড়েছে। সে কালে সকাল থেকে অনভ্যাসের ভাং, পিচকারি, জলবেলুন প্রভৃতির কোটা পেরিয়ে যাওয়ার পরে দোলখেলা অবধারিত গড়িয়ে যেত নর্দমার জল, বাঁদুরে রং ইত্যাকার শয়তানিতে। তখন সকলেই নিরাপদ রকমের টালুমালু। তার সঙ্গে ‘খেলব হোলি রং দেব না’-র আবডালে ঈষৎ প্রগল্‌ভ, অতিরিক্ত স্মার্ট এবং বেপরোয়া। বিত্তে মূলত মধ্য কিন্তু চিত্তে বলশালী সেই আবাসনের একচিলতে পার্কে যখন ঢোল ইত্যাদি নিয়ে হুল্লোড় তূরীয় পর্যায়ে, তখন এক সিনিয়র দাদা নিয়ে এলেন তাঁকে। আমরা, এঁচড়ে পাকা ছেলের দল খানিক অপাঙ্গে দেখলাম ‘ক্লিন শেভন’ এবং একমাথা এলোমেলো চুলের প্রতুলকে। যেমন দেখতাম কখনও কখনও তাঁকে আলগোছে হেঁটে যেতে আবাসনের মাঝ বরাবর রাস্তা ধরে। দেখতাম। চিনতাম। কিন্তু জানতাম না।

    জানতাম না, তিনি প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন ছাত্র। বিষয় রাশিবিজ্ঞান (আমার মতো অর্বাচীন যাকে সভয়ে দূর থেকে ‘স্ট্যাটিসটিক্স’ বলি এবং যাঁরা সেটা পাঠ্যসূচিতে ধারণ করার মতো মেধাবী হন, তাঁদের ভক্তিভরে দেখি)। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বড় চাকুরে। আবাসনের যে অংশটাকে অনেকে ‘বাংলাদেশ’ (সম্ভবত ইংরেজি অ্যালফাবেটের শেষ দিকের অক্ষর এক্স, ওয়াই, জ়েড ব্লকগুলো ওই দিকে ছিল বলে) বলতেন, সেখানে সস্ত্রীক থাকতেন দোতলার একটি ফ্ল্যাটে। হ্যালহ্যালে বুশ শার্ট বা ঢোলা পাঞ্জাবি, ফ্যাতফ্যাতে ট্রাউজ়ার্স, চোখে রিমলেস চশমা আর বাঁ-কব্জিতে মেটাল স্ট্র্যাপের ঘড়িটি পরে মলিন এবং বহুব্যবহৃত নাইলনের থলে হাতে বাজার যেতেন। কখনও তাঁকে আলাদা বা বিশেষ মনে হয়নি। ২১৬টি ফ্ল্যাটের মধ্যে একটির আপাত অকিঞ্চিৎকর বাসিন্দাকে (সেই আবাসনে বাম সরকারের মন্ত্রী এবং নেতাদেরও বাস ছিল) কখনও সম্ভ্রম বা সমীহ দেখাইনি। বুঝতেও পারিনি (না কি বুঝতে চাইনি), ওই যে লোকটা টুকটুক করে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা বেয়ে চলে যাচ্ছে, সে একটা ‘ঘটনা’।

    তো, সেই ‘ঘটনা’টি সে দিনও টুকটুক করে এসে হাজির হলেন সেই ছোট পার্কের আরও ছোট একটা কোনায়। তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে মাটিতে বসে আমাদের চেয়ে দু’-তিন প্রজন্মের বড় দাদারা। সেই বৃত্তের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে দু’চোখ বন্ধ করে দু’হাতের আঙুলে তুড়ি মেরে খোলা এবং খালি গলায় গান ধরলেন প্রতুল।

    কী গাইছিলেন, এত দিন পরে আর মনে নেই। ‘ডিঙ্গা ভাসাও’ হতে পারে। ‘আমি এত বয়সে’ হতে পারে। ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু যেটা মনে আছে, উটকো একটা লোক এসে দোলের রসভঙ্গ করছে দেখে আমরা পাকা, ডেঁপো এবং ত্যাঁদড় ছেলেরা চোখে চোখে ইশারায় ঠিক করলাম, এই রবাহূতকে যথাসম্ভব দ্রুত থামাতে হবে। ব্যস, চৌদুনে উঠল ঢোল। তার সঙ্গে বেসুরো গলায় ‘সিলসিলা’ খ্যাত ‘রং বরসে..’ এবং মহাচিৎকারে ‘হোলি হ্যায়’। যুদ্ধের কাড়া-নাকাড়াই বেজে উঠল বুঝি।

    সিনিয়রেরা কটমটিয়ে তাকালেন। কিন্তু কেউ উঠে এসে শাসন করলেন না। করার প্রশ্নও ছিল না। একে ‘যৌবনজলতরঙ্গ’। তার উপর আবার কিঞ্চিৎ স্খলিত এবং শিথিল। যাদের লঘু-গুরু জ্ঞান তত ক্ষণে লোপ পেয়েছে। প্রতুল কিছু ক্ষণ চেষ্টা করলেন। গোটা তিনেক গান গাইলেন। তার পরে রণে ভঙ্গ দিলেন। কারণ, সমবেত বেসুরো এবং উচ্ছৃঙ্খল গলার সামনে তাঁর সুরেলা কণ্ঠ ডুবে যাচ্ছিল। খানিক উদাসীন তিনি যখন পার্ক ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন কি পিছন থেকে কিছু তরলমতির হ্যা-হ্যা হাসি তাঁর কানে পৌঁছোচ্ছিল? কে জানে!

    সে দিনের পর আর কখনও তাঁর মুখোমুখি হইনি। একই পাড়ায় থাকা সত্ত্বেও হইনি। বরং তাঁকে এড়িয়ে চলেছি। দোলের খোঁয়াড়ি ভেঙে যাওয়ার পরে ঘোর লজ্জিত লেগেছিল। এতটাই যে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ষশেষের সালতামামিতে যখন অ্যাসাইনমেন্ট এল ‘একের মধ্যে তিন ধারায় বাংলা গানের ফিরে আসা’ শীর্ষক লেখার, তখন সেই নিবন্ধে (আমার সঙ্গে যৌথ ভাবে লিখেছিলেন অগ্রজ সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য) প্রতুলকে সেই ধারার ‘জনক’ বলে বর্ণনা করলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারিনি। স্রেফ লজ্জার চোটে। একই পাড়ার বাসিন্দা। কলিং বেল টিপে ঢুকে পড়তেই পারতাম। পেশাগত ভাবে উচিতও ছিল। কিন্তু পারিনি। ওই দোলের দিনের অভব্যতাটা তাড়া করছিল। পিছন থেকে ঘেঁটি ধরে মাথা নুইয়ে দিচ্ছিল। কথা বলব কী করে!

    সম্ভবত সেই কারণেই প্রতুলের সঙ্গে কোনও দিনই গিয়ে কথা বলা হয়নি। ওই লজ্জা এবং অনুতাপ বোধ থেকে। কখনও-সখনও যে পেশাগত বৃত্তে তাঁর মুখোমুখি পড়ে যাইনি এমন নয়। তখন পালিয়ে বেঁচেছি! যাকে বলে সটকে পড়েছি। কিন্তু তাঁর গান শুনেছি ভারী আগ্রহ নিয়ে। ক্যাসেট-সিডি কিনেছি। দূর থেকে ভক্তি করেছি। বাংলার মতো একটি আপাত-প্রান্তিক এবং আঞ্চলিক ভাষায় সাংবাদিকতা করি বলে যখন ভিন্‌রাজ্যের সবজান্তা সাংবাদিক রোয়াব নিয়েছে, তখন নিজের মনে মনে গুনগুন করেছি, ‘আমি বাংলাকে ভালবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’।

    খানিক চিকন গলা (অনেকে বলতেন, যথেষ্ট পুরুষালি নয়)। কিন্তু উচ্চারণের তীক্ষ্ণতা আর নাটকীয়তায় ভরা প্রতুলের কণ্ঠ বরাবর তাঁর নিজস্ব থেকেছে। ‘স’ বা ‘শ’ দিয়ে শুরু শব্দগুলোর উচ্চারণে এতটাই যত্ন ছিল যে, শিসের মতো ধ্বনি নির্গত হত দু’ঠোঁটের ফাঁক গলে (চট করে মনে পড়ছে ‘শাবাশ’ শব্দটা)। গান গাইতেন সারা শরীর দিয়ে। কথা বলার সময় ঘন ভ্রুর তলায় তাঁর জ্বলজ্বলে চোখ কথা বলত। ঠা-ঠা করে হাসতেন। কিন্তু গাইতেন চোখ বন্ধ করে। তদ্গত হয়ে। গাইতে গাইতে মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি খেলে যেত।

    আরও একটা বিষয় বিস্ময়কর লাগত। অন্য অনেক তথাকথিত গুণীজনের মতো প্রতুলের অর্থ বা খ্যাতির লিপ্সার কথা শোনা যেত না। অন্তত তখনও পর্যন্ত। বিস্ময়কর বইকি!

    আরও বিস্ময়কর— একটা লোক কোনও ধরনের বাদ্যযন্ত্রের সহায়তা না নিয়ে স্রেফ হাতে-হাতে তালি আর আঙুলে-আঙুলে তুড়ি মেরে একটা গানের আস্ত আসর তৈরি করে ফেলছে! না জানলে বিশ্বাস হত না। যত শুনেছি, মনে হয়েছে, কী আশ্চর্য এবং তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস এই ভদ্রলোকের! যে, আমার কোনও যন্ত্রীর দরকার নেই। আমার গলাটাই সব। সেখানেই আমার প্রথম এবং শেষ দাপট। শুনলে শোনো, না শুনলে শুনো না। আমি গেয়ে চলে যাব। পাখির কূজনের মতো। আশ্চর্য নয় যে, প্রতুল বরাবর মনে করেছেন, সৃষ্টির মুহূর্তে লেখক বা শিল্পীকে একেবারে একা হতে হয়। সেই সৃষ্টিকে জনতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া গেলে তবেই সেই একাকিত্ব সার্থক হয়। তখনই একক সাধনা সর্বজনীন হয়ে ওঠে। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি একাকী ছিলেন তাঁর সৃষ্টি, তাঁর লেখা, তাঁর সুর এবং তাঁর গান নিয়ে। ভারভাত্তিক ‘সঙ্গীতশিল্পী’ নয়, তিনি ছিলেন এক একলা ‘গায়েন’। ‘বায়েন’ নয়।

    কিন্তু ‘গায়েন’ হলেও একটা বড় সময় পর্যন্ত প্রতুল ছিলেন, যাকে বলে, প্রকোষ্ঠ গায়ক। এই শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন ঘরোয়া আসরে বা একশো-দেড়শো আসনের প্রেক্ষাগৃহে খুব ছোট ছোট খোপে তাঁর গান শোনা যেত। অত্যন্ত পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। অতি বাম রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন (মাওয়ের কবিতার অনুবাদে সুর দিয়ে গান তৈরি করে গেয়েছেন। মদ্যপান-বিরোধী গান গেয়েছেন ভাটিখানার সামনে দাঁড়িয়ে)। সেই সম রাজনীতিক মানসিকতার লোকজনই তাঁর গানের শ্রোতা ছিলেন। এবং তাঁরা বলেন, গান শোনানোর জন্য প্রতুলকে কোনও দিন সাধ্যসাধনা করতে হয়নি। বললেই হত। গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো। পিন চাপালেই গান শুরু।

    নিজের মতো করে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তবে চোখে পড়েছিলেন কানোরিয়া জুটমিল আন্দোলনের সময়। তার পরে তাঁর (এবং তাঁর মতো আরও অনেকেরই) অবধারিত গন্তব্য ছিল ‘পরিবর্তন’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি থেকেছে। সেই পর্বেই তাঁর সঙ্গে হবু মুখ্যমন্ত্রীর আলাপ। মমতার রাজনীতির সঙ্গে তাঁর রাজনীতির বুনিয়াদি তফাত ছিল। কিন্তু প্রতুল মমতার রাজনীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বদলে মমতাও তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। ব্যক্তিশ্রদ্ধা তো বটেই, আন্দোলনের সহযাত্রী হিসেবেও।

    তখন থেকেই কি ‘গায়েন’ প্রতুলের আরও বিস্তৃতি হল? প্রকোষ্ঠ ছেড়ে জনদিগন্তে উড়াল দিল তাঁর কণ্ঠ? সম্ভবত তা-ই। নইলে যে প্রতুল একদা নিছক নিভৃত এবং ব্যক্তিগত খোপের গায়ক ছিলেন, তিনি ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ ছবিতে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন? না কি তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি হয়?

    অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্ম। সরকারি স্কুলের শিক্ষক বাবা এবং গৃহবধূ মায়ের সঙ্গে দেশভাগের সময় ভারতে চলে আসা, হুগলির চুঁচুড়ায় শৈশব কাটানো প্রতুলের প্রথম যে অ্যালবাম শুনি, তার নাম ছিল ‘যেতে হবে’। ছোটবেলা থেকে নিজের লেখা আর সুরে গান গাইতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় সুর দিয়েছিলেন বালক প্রতুল। সেই তাঁর যাত্রা শুরু।

    নানা ধরনের উচ্চাবচ পরিক্রমার পরে যে যাত্রা শেষ হল মধ্য ফেব্রুয়ারির এক বসন্ত বিকেলে রবীন্দ্রসদন চত্বরে একুশ তোপধ্বনির রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। যে তোপধ্বনির প্রতিটিতে হাট করে খুলে যাচ্ছিল চল্লিশ বছর আগের সেই দিনটার একেকটা দরজা-জানালা। এক বসন্তে কিছু বাচাল তরুণ এবং এক উদাসীন গায়ক। সমবেত রংবাজি এবং চিৎকারে যাঁর কণ্ঠ ডুবে গেল। ওই তিনি ধীর পদক্ষেপে একচিলতে ঘাসের জমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছেন হুল্লোড় থেকে দূরে। রং ছেড়ে ঢুকে পড়ছেন সাদা-কালোর দুনিয়ায়। ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে তাঁর অস্পষ্ট অবয়ব।

    চল্লিশ বছর পরের এক বসন্তে সেই ফ্ল্যাশব্যাক দেখতে দেখতে সে দিনের সেই তরুণ নতজানু এবং নতশির হয়ে সেই গায়েনের সুরারোপ করে গাওয়া শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’র প্রথম লাইনটি নিজের কানে কানে বলছিল, ‘এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/আজ বসন্তের শূন্য হাত—’।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)