• স্মৃতির পাতায় ‘পশ্যাশ্রয়’, ‘গুলমাখোলা’ স্টেশন
    এই সময় | ০২ মার্চ ২০২৫
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি

    সে এক সময় ছিল বটে! ভিস্টাডোম কোচ ছিল না। ছিল না ব্রডগেজ লাইন। কিন্তু ভ্রমণের আনন্দ, কিছু কম ছিল না। শিলিগুড়ি জংশন থেকে সেই সময়ে যাঁরা ডুয়ার্সের দিকে গিয়েছেন, এখনও মনে করতে পারেন তাঁরা। জংশন পার হতে না-হতেই চা বাগানের ভিতরে হাজির হতো ছোট্ট একটি স্টেশন। নাম পশ্যাশ্রয়। মানে পশুদের আশ্রয়।

    স্টেশন কী করে পশুদের আশ্রয়স্থল হতে পারে সেটাও ওই স্টেশন যাঁরা দেখেননি, তাঁদের অনুমান করা কঠিন। স্টেশনের অনতিদূরেই মহানন্দার অভয়ারণ্য। প্রায়ই বিকেলের দিকে স্টেশনে চলে আসত বুনো হাতির পাল। বর্ষায় জঙ্গল থেকে বার হয়ে আসত অজগর। রেল লাইনের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে রোদ পোহাত তারা। পশ্যাশ্রয় পেরোলেই গুলমা স্টেশন।

    তার পরে আরও এক মজার অভিজ্ঞতা। মহানন্দা অভয়ারণ্যের ভিতরেই ছিল আরও একটি স্টেশন। নাম গুলমা খোলা। দিনে দুপুরে সেখানে বুনো হাতি কিংবা বাইসনের দল হানা দিত। ভয়ে স্টেশন মাস্টার অফিসের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতেন। রাত হলে কেউ ঘর থেকে বেরই হতেন না। প্রায়ই ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিতে হতো চালককে। কেননা, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতির পাল।

    ২০০০ সাল নাগাদ সেই মিটারগেজ লাইন তুলে দিলেন রেল কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে তুলে দেওয়া হলো পশ্যাশ্রয় আর গুলমা খোলা। এখন শিলিগুড়ি জংশন থেকে ট্রেন ছাড়লে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় গুলমা স্টেশনে। তার পরে সেবক। পশ্যাশ্রয় কিংবা গুলমা খোলার কথা লোকে ভুলেই গিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য মনে রেখেছেন। যেমন গোবিন্দ শর্মা।

    পেশায় রাজমিস্ত্রি গোবিন্দর বাড়ি কয়েক কিলোমিটার দূরে চম্পাসারি বটতলায়। শৈশবে শীতকালে গোবিন্দ প্রায়ই চলে আসতেন পশ্যাশ্রয় স্টেশনে। কারণ, রেল লাইনের দু’পাশে তখন কুলের গাছের জঙ্গল। গরম কালেও চলে আসতেন। রেল লাইন ধরে সোজা হাঁটা দিতেন গুলমা স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে মহানন্দা নদীতে নেমে স্নান। তখন শিলিগুড়ি ছিল একেবারে অন্যরকম। চম্পাসারি মোড় পার হলে উত্তর দিকে লোকালয় বলে কিছু ছিল না। একটা দু’টো আদিবাসীদের বাড়ি। লোকালয় যে টুকু ছিল, সেটা ওই পশ্যাশ্রয় আর গুলমা স্টেশনকে ঘিরে।

    পশ্যাশ্রয় স্টেশন একেবারে দাগাপুর চা বাগান ঘেঁষা। তার পরেই মোহরগাঁও গুলমা চা বাগান। চা বাগানের শ্রমিকেরা ট্রেনে চেপে ডুয়ার্সে যেতেন। একবার গোবিন্দও মায়ের হাত ধরে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন।

    গোবিন্দ বলেন, ‘স্টেশনটা দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যেত। ছোট্ট স্টেশন। লোকজন একটা ছিল না। সারাদিনে একটা কী দু’টো ট্রেন এই লাইনে যাতায়াত করত। এখন সারাদিন ধরে ট্রেন যায়। কিন্তু স্টেশনটা হারিয়ে গেল।’ কেবল স্টেশনই নয়, চম্পাসারি, গুলমার চেহারাও বদলে গিয়েছে। আগে যেখানে ছিল ধূ ধূ মাঠ, চাষের খেত, এখন সেখানে চারদিকে কেবল বাড়ি।

    দখলদারদের অত্যাচার থেকে রেহাই মেলেনি চা বাগানের অব্যবহৃত জমিও। চম্পাসারি বাজার পেরিয়ে লোকালয় এখন চলে এসেছে গুলমা স্টেশনের পিছনে মহানন্দার জঙ্গলের ফাঁকা জমিতেও। পশ্যাশ্রয় রেল স্টেশনের পাশেই এখন গড়ে উঠেছে একটি রেল গেট। ট্রেন এলে পালা করে ছ’জন রেলকর্মী গেট বন্ধ করেন। আবার খুলে দেন।

    তেমনই এক কর্মী সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘পশ্যাশ্রয় রেল স্টেশনের নাম আমিও শুনেছি। এখনও সামান্য কিছু সিমেন্টের চিহ্ন দেখে বোঝা যায়। তবে স্টেশনটি যে বেশ সুন্দর ছিল, সে কথা আমিও শুনেছি।’

  • Link to this news (এই সময়)