সুমন তেওয়ারি, আসানসোল: তোমার আমার হলুদ ট্যাক্সিটা। ছুটে গিয়েছিল শহরের মোড় থেকে মোড়। চাকার শব্দে গল্প বলেছে সে। সাক্ষী থেকেছে চৌরঙ্গী চত্বর।
তিলোত্তমা কলকাতার সঙ্গে একদা হার্দিক সম্পর্ক ছিল এই হলুদ ট্যাক্সির। সেটা যেমন ছিল বাবু কালচারে, তেমনিই আবার নিম্মবিত্তদের শখ পূরণেও।
তাকে ঘিরে আজও কত স্মৃতি ভেসে ওঠে সিনেমার পর্দায়, গানে-কবিতায়। তার আজ বড্ড অভিমান! নতুনকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় নিতে হচ্ছে তাকে। একসময় সবাইকেই নিতে হয়। যেমন, একে একে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি, হাতে টানা রিকশ, ঐতিহ্যবাহী ট্রাম। হলুদ ট্যাক্সিও এবার হারানোর পথে। যেতে গিয়েও যেন তার যাওয়া হচ্ছে না! হবেই বা কী করে? তার ভালোবাসার যে অমোঘ টান! তাই সে ফিরে ফিরে আসে নানা সৃষ্টিকর্মে—সময়ের সাক্ষী হয়ে।
রুপোলি পর্দা, গান, কবিতা, সাহিত্যের পথ উজিয়ে হলুদ ট্যাক্সি এবার সাক্ষী বাংলার তাঁতশিল্পে। শাড়ির চওড়া আঁচলে, গায়ে সগর্ব উপস্থিতি তার। শিল্পীর নিপুন হাতের ছোঁয়ায় সে যেন কলকাতার মূর্ত প্রতীক। তাই হয়তো আসানসোলের রাজ্য হস্তশিল্প মেলাতেও সুপার হিট হলদু ট্যাক্সির শাড়ি। তাকে দেখতে ভিড়। কেনকাটাতেও লাইন। নয়া প্রজন্মের কিশোরী, তরুণীরাও কলকাতার অহঙ্কারকে নিয়ে চর্চায় মেতে। আসলে সকলেই ফিরে দেখতে চায় পুরনো কলকাতাকে।
আজ বড্ড বুড়ো হয়ে গিয়েছে কলকাতার সেই হলুদ ট্যাক্সি। তার উৎপাদনের কারখানা ‘হিন্দ মোটর’ও প্রায় ধ্বংসস্তূপ। যে হাতে গোনা কয়েকটা এখন কলকাতায় চলাচল করে, তা কেবলই স্মৃতির নিশান। সেই নিশান যদি গায়ে ঘোরে তাতে গর্ববোধ হয় বৈকি। তাই হয়তো হলুদ ট্যাক্সির শাড়ির চাহিদা এতবেশি তুঙ্গে। হাতে গরম প্রমাণ রাজ্যের হস্তশিল্প মেলা।
আসানসোলের পোলো মাঠে বসেছে এই মেলা। এসেছেন কলকাতার হস্তশিল্পীরাও। তাঁদের প্রায় সকলেই পসার সাজিয়ে বসেছেন হলুদ ট্যাক্সির চিত্রায়ণের শাড়ি নিয়ে। যেমন হস্তশিল্পী মনিকা নন্দী। তিনি বলছিলেন, ‘হলুদ ট্যাক্সি আমাদের তথা কলকাতার আত্মপরিচয়। একদা কলকাতার লাইফ লাইন। স্বভাবতই তার ছবি আঁকা শাড়ির বিশেষ চাহিদা রয়েছে। সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি।’ হলুদ ট্যাক্সির পাশাপাশি বহু শাড়িতে ঠাঁই পেয়েছে হরেক বুটিকে কাজও। মনিকতলার হস্তশিল্পী সোমনাথ চন্দ্র কয়েক বছর ধরেই ব্লক ওরিয়েনটেশনের কাজ করছেন। তাঁর অপরূপ কাজে ফুটে উঠছে মণীষী থেকে সিনারি সবই। কলকাতার আর এক শিল্পী ড্রাইফ্রুটের খোসা দিয়ে গৃহসজ্জার সামগ্রী দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। হস্তশিল্প মেলায় নদীয়ার স্টলে কৃষ্ণনগরের নতুন ধরনের পুতুলের কাজ মানুষের নজর কাড়ছে। পশ্চিম বর্ধমানের হস্তশিল্পীরাও নিজেদের তৈরি সামগ্রী দিয়ে অন্য জেলাকে টেক্কা দিচ্ছে।
এদিন মেলায় এসেছিলেন বছর কুড়ি বাইশের ক্রেতা মোনালিসা রক্ষিত, বিদিতা বসুরা। তাঁরা বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় কোনও কারণে কলকাতায় গেলে হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ার বায়না ধরতাম। সেই ট্যাক্সিকে এভাবে শাড়ি বহন করবে, ভাবতেই পারছি না। আমরা সবাই কিনেছি। ভাবছি স্মৃতির আলমারিতে সাজিয়ে রাখব।’ • নিজস্ব চিত্র