বহু দুষ্প্রাপ্য তালপাতার পুঁথি নিয়ে ধুঁকছে নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার
বর্তমান | ০৩ মার্চ ২০২৫
সংবাদদাতা, নবদ্বীপ: একসময় সংস্কৃতচর্চার পীঠস্থান নবদ্বীপ ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ আখ্যা পেয়েছিল। ১১৮বছরের এই প্রাচীন গ্রন্থাগারে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য পুঁথি রয়েছে। তালপাতা, গাছের বাকল বা তুলট কাগজে লেখা সেই সমস্ত পুঁথিতে ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ও ন্যায়শাস্ত্রের পাশাপাশি শ্রীচৈতন্যদেব ও বৈষ্ণবমত-সম্পর্কিত নানা তথ্য রয়েছে। কিন্তু এই প্রাচীন গ্রন্থাগারটি এখন চরম অবহেলায় পড়ে আছে। বহুদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ঘরের মেঝে বসে যাচ্ছে। ঘরের পলেস্তারা খসে পড়ছে, ভেঙে গিয়েছে জানালার কাচ। অর্থাভাবে ঠিকমতো দেখভাল করতে না পারায় বহু পুরনো আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় নিরাপত্তার অভাবও রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগারের জীর্ণ দশায় হতাশ নবদ্বীপের বইপ্রেমীরা। অবিলম্বে এই প্রাচীন গ্রন্থাগার সংস্কার ও কর্মী নিয়োগের দাবি উঠেছে।
জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক প্রবোধ মাহাত বলেন, ওই লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ সংস্কারের বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেটা ঊর্ধ্বতন মহলে পাঠানো হয়েছে। সিসি ক্যামেরা বসানোরও একটি প্রস্তাব রয়েছে। মার্চের মধ্যে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে।
এই প্রাচীন গ্রন্থাগারে ২০৪৬টি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি রয়েছে। কোনওটি দেবনাগরি লিপি, কোনওটি গৌরী লিপিতে লেখা। আবার প্রাচীন বাংলায় লেখা পুঁথিও রয়েছে। এখানে আছে বিষ্ণুপুরাণ, স্কন্দপুরাণের পাশাপাশি রয়েছে চৈতন্য চরিতামৃত, আয়ুর্বেদ, ধর্মশাস্ত্র ও ন্যায়শাস্ত্রের নানা পুঁথি। এছাড়া, বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি সহ নানা ভাষায় ১৬৮১২টি বই আছে। বিভিন্ন সময়ে এই গ্রন্থাগারে এসেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও প্রফুল্লচন্দ্র সেন, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক এস আর রঙ্গনাথন, জাদুসম্রাট পি সি সরকার, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সহ অন্য স্বনামধন্য ব্যক্তিরা।
এই গ্রন্থাগারে মাত্র একজন কর্মী রয়েছেন। তিনি কোনওদিন অনুপস্থিত থাকলে লাইব্রেরি বন্ধ থাকে। গ্রন্থাগার পরিচালন কমিটির সভাপতি হিমাংশু সাহা বলেন, লাইব্রেরি বাঁচাতে টাকা ও কর্মী-দু’টোই প্রয়োজন। এই প্রাচীন গ্রন্থাগার শুধু হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। কিন্তু তার কোনও সুফল পায়নি।
ইংরেজ আমলে ১৯০৭ সালের ১৭ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলায় নবদ্বীপ পাবলিক লাইব্রেরি চালু হয়েছিল। সেসময় পণ্ডিত অজিত নাথ ন্যায়রত্নের সভাপতিত্বে একটি নাগরিক সভার মাধ্যমে লাইব্রেরির পথ চলা শুরু হয়। পরে ১৯১০ সালের ৩০মে এর নাম সপ্তম এডওয়ার্ড অ্যাংলো-সংস্কৃত লাইব্রেরি রাখা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৫৫সালের ৯ অক্টোবর লাইব্রেরির নাম রাখা হয় নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার। ১৯৫৮সালের ডিসেম্বরে এটি টাউন লাইব্রেরির স্বীকৃতি লাভ করে।
গ্রন্থাগার পরিচালন কমিটির সম্পাদক নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পুঁথিগুলি ভঙ্গুর হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারবছর আগে একটি সংস্থার মাধ্যমে ওই সমস্ত পুঁথি ডিজিটাইজেশন করা হয়েছে। তবে এখনও সম্পূর্ণ ক্যাটালগ হাতে পাইনি। সেসব পেলে সুবিধা হবে। সবাই যাতে এসমস্ত পুঁথি দেখতে পারেন, সেজন্য আমরা একটি ওয়েবসাইট তৈরির চেষ্টা করছি। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, এই লাইব্রেরির দিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।