এই সময়: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার ওয়েবকুপার বার্ষিক সম্মেলন চলাকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর উপস্থিতিতে ছাত্রদের একাংশের বিক্ষোভের জেরে পরিস্থিতি রণক্ষেত্র হয়ে ওঠার ঘটনায় সাতটি এফআইআর দায়ের হলো যাদবপুর থানায়। এর মধ্যে ওয়েবকুপার সদস্য দুই শিক্ষক–শিক্ষিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া টিএমসিপি সমর্থক এক ছাত্র, যাদবপুরের শিক্ষাবন্ধু সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের অভিযোগের ভিত্তিতে বেআইনি জমায়েত, শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকী খুনের চেষ্টার মতো গুরুতর ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে।
আবার গাড়ির ধাক্কায় জখম হওয়ার পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছেন এক পড়ুয়া। এর পাশাপাশি বিক্ষোভ চলাকালীন শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি আটকানো, ধস্তাধস্তি, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের মতো বিভিন্ন অভিযোগে কলকাতা পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত দু’টি মামলা দায়ের করেছে। কোনও অশান্তির ঘটনায় অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগের ঘটনা নতুন নয়। তবে একটি ঘটনায় সাত–সাতটি মামলা রুজু হয়েছে, তা–ও আবার কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে— এমনটা বেনজির বলেই মনে করছেন পুলিশ ও শিক্ষাকর্তাদের অনেকে।
রবিবার লালবাজারে সাংবাদিক বৈঠকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা বলেন, ‘সাতটি এফআইআর হয়েছে। দু’টি মামলা করেছে পুলিশ। একজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। তদন্ত চলছে। তাঁকে ১২ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে কোর্ট।’ পুলিশ সূত্রের খবর, এই সাতটি মামলায় মোট ৪৮ জন প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের নজরে রয়েছেন। তাঁর মধ্যে শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষাবন্ধু সমিতির অফিসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মহম্মদ সাহিল আলি যাদবপুরের এক প্রাক্তন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে এ দিন যাদবপুরের উপাচার্য ভাস্কর গুপ্ত বলেন, ‘খুব বাড়াবাড়ি হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব। তবে এটা আমার একার সিদ্ধান্ত হতে পারে না।’
যাদবপুরে গিয়ে শনিবার পড়ুয়াদের একাংশের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। ধস্তাধস্তিতে চোট পান শিক্ষামন্ত্রী। আবার শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় এক ছাত্র জখম হন বলে অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায় গুরুতর জখম হলেও তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। এ দিন অবশ্য ব্রাত্য জানান, তাঁর গাড়ির চাকার তলায় চলে গিয়ে ওই ছাত্র জখম হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠছে, তা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। আমি আমার গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, ব্রেক কষা হলে ছেলেটি পাশে ছিটকে পড়ে। গাড়িটা যদি চলে তা হলে তো এ রকমটা হওয়ার কথা নয়।’
শনিবারের ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘(বিশ্ববিদ্যালয়ের) উপাচার্যকে পর্যন্ত শারীরিক ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। অনেক অধ্যাপককে মারধর করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক ভাবে এর মোকাবিলা করব।’ তাঁর সংযোজন, ‘আমি রাজনীতি চাইনি। আমি রাজনৈতিক ভাবে চাইলে, আমাদের ওখানে (যাদবপুর এলাকা) যিনি রাজনৈতিক ভাবে দেখাশোনা করেন, আমার সহকর্মী অরূপ বিশ্বাস, তাঁকে বলেই আমি ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম। তাঁকেও আমি কিছু বলিনি। কারণ, আমার মনে হয়েছে, ওখানে অধ্যাপকরা সভা করতে যাচ্ছেন। সেখানে কেন বাইরের রাজনৈতিক লোকের সাহায্য নিয়ে ঢুকব? কিন্তু ওখানে যে অধ্যাপকদের ধরে পেটানো হতে পারে, সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না।’
তা হলে গাড়ির ধাক্কায় ইন্দানুজ জখম হলেন কী ভাবে?
ব্রাত্যর কথায়, ‘আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম না। আমার চালক চালাচ্ছিল। ড্রাইভার প্রাণভয়ে ছিল। ছাত্রের যেমন প্রাণের আশঙ্কা রয়েছে, তেমনই মন্ত্রীর গাড়ির ড্রাইভার বলে কি সে মানুষ নয়? তার প্রাণের আশঙ্কা থাকবে না? আমার গাড়ির চালক প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এলোমেলো গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছিল। আমি বললাম, আস্তে আস্তে চলো। ততক্ষণে গাড়ির কাচটা ভেঙে এসে আমার গায়ে পড়ে। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। যে ছেলেটি আহত হয়েছে, তার জন্য সত্যিই আমার খারাপ লাগছে।’
শিক্ষামন্ত্রী আরও জানান, আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ তখনই জানাতে হবে। সেটা তখনই জানানো সম্ভব ছিল না। তাঁর সংযোজন, ‘ছাত্রদের শত্রু বলে ভাবতে রাজি নই। আমি যেমন তাকে শত্রু হিসেবে দেখব না, সে–ও যেন শাসকদলকে শত্রু না মনে করে।’ যাদবপুরের ঘটনায় পুলিশি পদক্ষেপ নিয়ে ব্রাত্যর বক্তব্য, ‘এই ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট চাইছি। আমরা পুলিশ ডাকিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে তো একটা নিরাপত্তা টিম থাকবে। সেটা চোখে পড়েনি।’
এ দিন কলকাতার যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) রূপেশ কুমার জানান, সাতটি এফআইআরের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে অভিযুক্তদের চিহ্নিতকরণেরও কাজ শুরু হয়েছে।