সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায় ■ পুরুলিয়া
জীবনের অঙ্গ যে জঙ্গল আজ সেখানে আতঙ্কের ছায়া। জীবিকার জন্য যে জঙ্গলে ছুটে যাওয়া, সেখানে আজ বড়ই গা ছমছম। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয় জন্ম দিচ্ছে ফিয়ার সাইকোসিসের। আর তার পিছনে রয়েছে বাঘিনি জ়িনাত ও তার পিছু পিছু আসা বাঘ। নিজেদের ঘর–দুয়ারের মতো পরিচিত জঙ্গলে হঠাৎ দুই রয়্যাল বেঙ্গলের আবির্ভাব ঝড় বইয়ে দিয়েছে মানুষের মনে।
এখন যে কোনও প্রাণীকে দেখলেই তাঁদের বাঘ বলে বিভ্রম ঘটছে। গ্রাম লাগোয়া ছোট জঙ্গলটিতে পাতা কুড়োতে গিয়েছিলেন বান্দোয়ানের তালপাত গ্রামের প্রৌঢ়া অমলা মান্না। হঠাৎই একটি জন্তুকে জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা পার হতে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তাঁর। এলাকাটি রাইকা জঙ্গল থেকে পাঁচ কিমি দূরে। এখানেই এসেছিল বাঘ। ফলে সেই প্রৌঢ়া জঙ্গলে ফের বাঘ এসেছে ভেবে গ্রামে ছুটে যান।
গ্রামের মানুষও রয়্যাল বেঙ্গলের আতঙ্কে সিঁটিয়ে ওঠেন। এর মধ্যে চলে আসেন বনকর্মীরা। বহু খুঁজেও বাঘের কোনও পায়ের ছাপ পাননি তাঁরা। এর পর গত শুক্রবার মোটর বাইকে বান্দোয়ান থেকে কুইলাপালে যাচ্ছিলেন দিলীপ মাহাতো। রাতের অন্ধকারে হেড লাইটের আলোয় তিনি দেখতে পান, জঙ্গলের ভিতরে ছুটে ঢুকে গেল বিরাট একটি বাঘ। নিমেষে ওই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। এর পর দিন সকালে গ্রাম লাগোয়া মাঠে বিরাট থাবার ছাপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে যান ভাঁড়াড়ি এলাকার জালিম হেমব্রম।
সব মিলিয়ে পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, মানবাজারে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে বাঘ। বাঘিনি জ়িনাত ও পুরুষ বাঘ নিয়ে তৈরি হওয়া প্রাত্যহিক গুঞ্জনই এখন বনকর্তাদের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। তবে বিভ্রম রুখতে গ্রামবাসীর উপরেই ভরসা করছেন বনকর্তারা। বাঘিনী জ়িনাতের সময় থেকে কারও ক্ষতি হয়নি জানিয়ে সাধারণের মনে আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বান্দোয়ানের রেঞ্জ অফিসার বিপ্লব মল্লিক বলেন, ‘এত বড় একটি জঙ্গলে ঘেরা ভৌগোলিক পরিবেশ। তাতে অনেকরকম জন্তু থাকা স্বাভাবিক। তাদের দেখেই অনেকে ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। এ থেকেই তৈরি হচ্ছে রটনা। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’ যোগ করছেন, ‘মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে জঙ্গলের পথ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে বলা হচ্ছে।’
বন কমিটিগুলিও এ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। উদলবনির বাসিন্দা তথা রাইকা বন কমিটির সভাপতি সৃজন মুর্মু বলেন, ‘বনকর্মীরা গ্রামের মানুষের পাশে রয়েছেন। আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। অনেকেই শেয়াল, হায়না এমনকী কুকুর দেখেও বাঘ বলে ভেবে ফেলছেন। হয়তো মনের মধ্যে জমে থাকা আতঙ্ক থেকে এমন ঘটছে।’
লেদাশাল গ্রামের বাপ্পাদিত্য টুডু, কেশরার চিত্তরঞ্জন মুর্মুদের বক্তব্য, ‘বাঘ এই এলাকায় নতুন অতিথি। গ্রামের বহু মানুষ কখনও চিড়িয়াখানাতেও যাননি। ছবিতেই যে টুকু দেখা। আতঙ্ক থেকেই তাই বাঘ নিয়ে রটনা তৈরি হচ্ছে। এটা নিয়ে সভাও করছে বন দপ্তর।’ কংসাবতী দক্ষিণের ডিএফও পূরবী মাহাতো জানাচ্ছেন, এর থেকে দূরে থাকতে হবে মানুষকে। তিনি বলছেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে এগুলো বেশি ছড়াচ্ছে। বন্যপ্রাণ বনে রয়েছে, সে দিকে নজর রাখছেন বনকর্মীরা। কোনও মানুষের ক্ষতি হয়নি আজ পর্যন্ত। প্রতিটি গ্রামে মানুষকে এটাই বোঝানো হচ্ছে।’