প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিশানা হচ্ছেন প্রবীণেরা। কোথাও নিয়মিত বাড়িতে যাতায়াত থাকা কাউকে দিয়ে দরজা খুলিয়ে, কোথাও আবার গ্রিল কেটে ঢুকে পড়েছে ডাকাতের দল। এর পরে কখনও হাত-পা বেঁধে রেখে, কখনও বা শয্যাশায়ী প্রবীণের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে করা হয়েছে লুটপাট। শহরে একের পর এক এমন ঘটনায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের চিন্তা আরও বেড়েছে, কারণ বহু ক্ষেত্রেই অপরাধীদের ধরতে নাজেহাল হয়েছে পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এ শহরে কি নিরাপত্তা দিন দিন কমে যাচ্ছে? প্রবীণদের নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে মাঝেমধ্যেই নানা নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও কেন প্রবীণদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, উঠছে সেই প্রশ্নও।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশের অন্দরের দায় ঠেলাঠেলির কাহিনিই সামনে আসছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে একা থাকা বৃদ্ধার বাড়িতে ঢুকে লুটের ঘটনার পরে পুলিশের শীর্ষ স্তর থেকে নতুন করে প্রবীণদের জন্য তৈরি কার্যবিধি (এসওপি) মনে করানো হয়েছে। যা নিয়ে উত্তর কলকাতার একটি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বলছেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই থানায় অফিসার বদল হচ্ছে। প্রতিটি থানায় এক জন করে অতিরিক্ত সাব-ইনস্পেক্টর এবং তাঁর অধীনে দু’জন করে হোমগার্ড বা সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে নোডাল অফিসারদের একটি দল তৈরি করা হয়। কিন্তু কে, কবে বদলি হয়ে যাবেন, কেউ জানেন না। নতুন অফিসার এসে কাজের দায়িত্ব বুঝে নিতে নিতে দেখা যায়, তাঁরও বদলির নির্দেশ এসে গিয়েছে।’’ মধ্য কলকাতার একটি থানার এক অফিসার আবার বললেন, ‘‘চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, প্রবীণদের জন্য থাকা থানার নোডাল অফিসার বদলি হয়ে গিয়েছেন দু’বছর আগে। নতুন কাউকে কার্যভার বোঝানো হয়নি।’’ একই পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছেন সম্প্রতি দমদমে আক্রান্ত বৃদ্ধা। তাঁর দাবি, ‘‘লকডাউনে পুলিশ সাহায্য করতে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু তার আগে বা পরে পুলিশের কেউই কখনও আসেননি।’’
এই পরিস্থিতিতে সামনে আসছে প্রবীণদের জন্য তৈরি, কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্পের ‘মেডিক্যাল প্রিভিলেজ কার্ড’ এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রসঙ্গও। ২০২৩ সালে প্রণামের সদস্যদের জন্য পুলিশের ‘মেডিক্যাল প্রিভিলেজ কার্ড’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, এই কার্ডে দেওয়া কিউআর কোড স্ক্যান করলেই পাওয়া যাবে সংশ্লিষ্ট প্রবীণের অসুস্থতা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য। থানা থেকে পুলিশকর্মীরা গিয়ে প্রণামের সদস্যদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করে তাঁদের পুরনো সব প্রেসক্রিপশন জোগাড় করবেন। কেন্দ্রীয় ভাবে সেগুলি আপলোড করা থাকবে। প্রবীণেরা যাতে আরও দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবা পান, সেই লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ। একাধিক হাসপাতাল এবং ওষুধ বিপণির সঙ্গেও চুক্তি করার কথা বলা হয়েছিল পুলিশের তরফে। এতে নির্দিষ্ট কিছু ছাড় প্রবীণেরা পাবেন এবং প্রয়োজনের সময়ে তাঁদের জন্য কার্ড দেখে গ্রিন করিডর করে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, দু’বছর পেরিয়ে গেলেও প্রণামের সদস্যদের কেউই এই কার্ড পাননি। প্রণাম প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করতে দেখা গেল, কার্ড সম্পর্কে তাঁদেরও স্পষ্ট ধারণা নেই। ফোনে এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করুন, কার্ড কিছু থাকলে তাঁরাই বলতে পারবেন!’’
রিজেন্ট পার্কের বাসিন্দা, প্রণামের এক সদস্য বললেন, ‘‘কার্ডের আশ্বাস তো শুনতে ভালই লাগে। কিন্তু কেউ এসে কোনও তথ্য জানতে চাননি।’’ টালিগঞ্জের বাসিন্দা আর এক প্রবীণের বক্তব্য, ‘‘প্রেসক্রিপশন নেওয়া তো দূর, শব্দ-তাণ্ডবের কথা জানাতে ফোন করলেও থানা থেকে সাহায্য মেলে না।’’ পুলিশেরই একাংশের দাবি, বহু ক্ষেত্রে কার্ড তৈরি করার মতো প্রকল্প কর্তাদের ইচ্ছার উপরেও নির্ভর করে। যে পদস্থ কর্তা এমন কার্ডের কথা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো বদলি হয়ে গিয়েছেন। ফলে, কার্ডের ভাবনাচিন্তাও বন্ধ। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা এক বৃদ্ধা বললেন, ‘‘ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ফিরতেও এখন ভয় করে। যদি সমস্তটা লুট করে নিয়ে যায়! যদি বেঘোরে প্রাণ যায়!’’
কলকাতার নগরপাল মনোজ বর্মা বললেন, ‘‘ভয় পাওয়ার ব্যাপার নেই। প্রবীণদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।’’ প্রণামের ৮১ হাজার নিরাপদ সদস্য নিশ্চিন্তেই রয়েছেন— এমন দাবি করে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও নেই। সব ক্ষেত্রেই কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’
সত্যিই কি নিশ্চিন্তে রয়েছেন প্রবীণেরা? বাস্তব অভিজ্ঞতা যদিও অন্য কথাই বলছে।