• যাদবপুরে পেন ডাউন, ধর্মঘট ঘিরে উত্তপ্ত রাজ্য
    এই সময় | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • এই সময়: ক্লাসের মধ্যে পরীক্ষায় পেন ডাউন। ক্যাম্পাসের ভিতরে-বাইরে প্রতিবাদ, মিছিল। আর রাজ্যজুড়ে ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল ও তার পাল্টা ঘিরে সংঘাতের আবহ।

    গত শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলমালের ঘটনায় সোমবার এমনই ছবি ধরা পড়ল। এ দিন থেকেই শুরু হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। আর যাদবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে সোমবারই রাজ্যের সর্বত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল এসএফআই ও এআইডিএসও। ধর্মঘটের জেরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যাতে কোনও সমস্যায় না-পড়তে হয়, সে দিকে কড়া নজর ছিল পুলিশ-প্রশাসনের।

    পরীক্ষায় ব্যাঘাতের খবর না-এলেও দিনভর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এসএফআই, ডিএসও সমর্থকদের সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের সংঘর্ষের খবর মিলেছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুল থেকে পাঁশকুড়ার বনমালী কলেজের সামনে বেশ কয়েকটি জায়গায় লাঠি-বাঁশ নিয়ে খণ্ডযুদ্ধের ছবিও উঠে এসেছে। এমনকী বিক্ষোভের রেশ গড়িয়েছে রাজধানী দিল্লিতেও।

    এ দিকে, যাদবপুরের ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের দু’টি বেঞ্চে দু’টি আলাদা মামলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বকেয়া ছাত্র ভোটের দাবিতে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে চালু মামলায় নতুন করে শনিবারের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আবার সিঙ্গল বেঞ্চে যাদবপুরের সাম্প্রতিক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় অভিযোগ, ওই দিনের ঘটনায় মোট ৭টি এফআইআর দায়ের হয়েছে।

    অথচ বামপন্থী ছাত্রদের কোনও অভিযোগই গ্রহণ করেনি পুলিশ। উল্টে বাম ছাত্রদের মেসগুলিতে তল্লাশির নামে হেনস্থা এবং আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ আজ, মঙ্গলবার মামলাটি মেনশন করার নির্দেশ দেন। অন্য একটি মামলায় যাদবপুরের পড়ুয়াদের নিরাপত্তার দাবিও তোলা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলির মতো যাদবপুরেও পুলিশ আউট পোস্ট বসানোর আর্জি জানানো হয়। সুপ্রিম কোর্ট বা কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন কোনও বিচারপতিকে দিয়ে যাদবপুরের গোটা ঘটনাক্রমের তদন্তে একটি কমিটি গঠন এবং সিআইএসএফ বা অস্ত্রধারী পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থারও আবেদন রয়েছে।

    যে যাদবপুর ক্যাম্পাস থেকে গোলমালের সূত্রপাত, এ দিন সেখানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল সর্বাত্মক। পড়ুয়াদের পাশাপাশি ক্লাসে আসেননি অধিকাংশ শিক্ষক–শিক্ষিকাই। ক্যাম্পাসের পরীক্ষা ধর্মঘটের আওতার বাইরে থাকলেও যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সাতটি বিভাগের প্রথম বর্ষের সাতশোর বেশি পড়ুয়া পরীক্ষা হলে এসে অ্যাটেনডেন্স দিলেও পরীক্ষায় বসেননি। তবে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে মাস কমিউনিকেশন ও ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ল্যাটারাল এন্ট্রি দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হওয়া পড়ুয়ারাও পরীক্ষায় বসেছিলেন। অসুস্থ থাকায় ক্যাম্পাসে আসেননি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তও। তবে পড়ুয়াদের প্রতিবাদ প্রসঙ্গে ভাস্কর বলেন, ‘সেটা ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকার। ওরা ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমি কিছু বলতে পারি না। ওদের স্বাধীনতা আছে। শান্তিপূর্ণ ভাবে কথা হোক।’ তাঁর সংযোজন, ‘আমার প্রেশার প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছে। ডাক্তার আমাকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন।’

    ক্যাম্পাসের ভিতর-বাইরে প্রতিবাদ চললেও এ দিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তল্লাটে উত্তেজনা বাড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা মেটার পরে। সন্ধেয় এবিভিপির একটি মিছিল আচমকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেটের কাছে চলে আসে। এবিভিপি সমর্থকরা গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতে গেলে গেট আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়। সেই সময়ে ক্যাম্পাসে থাকা এসএফআই–র সমর্থকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষীদের পাশে এসে দাঁড়ালে তাঁদের সঙ্গে এবিভিপি সমর্থকদের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। ঘটনায় জখম হন অর্জুন নামে এক প্রবীণ রক্ষী। আবার এ দিন বিকেলে যাদবপুর ক্যাম্পাস থেকে গোলপার্ক পর্যন্ত মিছিলে সাধারণ পড়ুয়াদের পাশাপাশি সামিল হন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও। এই মিছিলে শনিবার ক্যাম্পাসে গাড়ির ধাক্কায় ছাত্রের জখম হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে পোস্টারও দেখা গিয়েছে। পাশাপাশি যাদবপুরের শিক্ষাবন্ধুর অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ধৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মহম্মদ সাহিল আলির মুক্তির দাবিও তুলেছেন পড়ুয়ারা। আজ, মঙ্গলবার আবার তৃণমূলের অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপা এইটবি বাস স্ট্যান্ড থেকে বিকেল পাঁচটায় ধিক্কার মিছিলের ডাক দিয়েছে।

    যাদবপুর ইস্যুতে ছাত্র ধর্মঘটের জেরে এ দিন উত্তপ্ত হয়েছে উত্তরবঙ্গ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়-সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস। টিএমসিপি-র সঙ্গে এসএফআই-সহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলির সংঘর্ষ হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে সিপিএমের পার্টি অফিসও। দিল্লিতে বঙ্গভবনের সামনে সিপিএম ও লিবারেশনের ছাত্র সংগঠনের শতাধিক কর্মী–সমর্থক বিক্ষোভ দেখান। দিল্লি পুলিশ–প্রশাসন জলকামান নিয়ে বড় বাহিনী মোতায়েন রাখায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

    বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএমসিপি-র সঙ্গে বাম ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তাতে সৌভিক ঘোষ নামে এক এসএফআই কর্মীর মাথা ফাটে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। অভিযোগ, এসএফআই–র সুচরিতা দাসকে পুলিশ মারতে পারতে ভ্যানে তোলে। মেদিনীপুর কলেজেও এসএফআই এবং ডিএসও-র সঙ্গে টিএমসিপি সমর্থকরা দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ান। এমনকী কয়েকজন ছাত্রীর উপরে কয়েকজন যুবক চড়াও হয়েছে— এই দৃশ্যও দেখা গিয়েছে। এসএফআই–র রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে–র অভিযোগ, ‘মেদিনীপুরে এক ছাত্রীকে পুলিশ হেফাজতে অত্যাচার করার খবর এসেছে। পুলিশ নিয়ে তৃণমূল একাধিক জায়গায় হামলা চালালেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ধর্মঘট সর্বাত্মক হয়েছে।’ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের সাফ কথা, ‘রাজ্যের সাত–আটটি জায়গায় এসএফআই ধর্মঘটের চেষ্টা করলেও সাধারণ ছাত্ররা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের একশোগুণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও টিএমসিপি কিছু করেনি।’

    পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া বনমালী কলেজের সামনে বাম ছাত্রদের সঙ্গে টিএমসিপি সমর্থকদের হাতাহাতি হয়েছে। সেখানে এক ছাত্রী নিগৃহীত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্মঘট সমর্থনকারীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে আজ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় অভিযানের ডাক দিয়েছে ডিএসও। যদিও দার্জিলিং জেলার টিএমসিপি-র সভানেত্রী পাপিয়া ঘোষের বক্তব্য, ‘আমাদের কোনও কর্মী কোথাও কাউকে মারধর করেনি।’ কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী জেনকিন্স স্কুলের সামনেও ডিএসও–র সঙ্গে টিএমসিপি–র সংঘর্ষ বাধে। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়েও বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে টিএমসিপি–র মারামারির খবর এসেছে।

    বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তির আঁঁচ এ দিনে ক্যাম্পাসের বাইরেও এসেছে। বারুইপুরে টিএমসিপি-র একটি মিছিল আচমকা সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা অফিসের দোতলায় উঠে পড়ে স্লোগান দিতে শুরু করে। সেই সময়ে সিপিএমের জেলা দপ্তরে ছিলেন সুজন চক্রবর্তী-সহ দলীয় নেতৃত্ব। অভিযোগ, সিপিএম অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেন টিএমসিপি সমর্থকরা। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য সিপিএম কর্মীরা তা‍লা ভেঙে দেন। সুজনের কথায় ‘টেলিভিশনে প্রচার পাওয়ার জন্য এই সব করেছে ওরা (টিএমসিপি)।’ যদিও তৃণমূলের এক মুখপাত্রের কটাক্ষ, ‘যাদবপুরে মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে সিপিএম যা করছে, তা সুজন সমর্থন করেন না। উনি নিজেই বলে দিয়েছিলেন অফিসে তালা লাগিয়ে দিতে, যাতে ওঁকে বাইরে বেরোতে না হয়।’

    শনিবার যাদবপুর ক্যাম্পাসে গাড়ির ধাক্কায় জখম ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায়ের শারিরীক অবস্থা এ দিন স্থিতিশীল বলে জানা গিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁকে জেনারেল বেডে রাখা হয়েছে। বাঁ দিকে চোখের নীচে গুরুতর আঘাত রয়েছে তাঁর। পাঁচ চিকিৎসকের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। যদিও ওয়েবকুপার তরফে এ দিন তৃণমূল কংগ্রেসের আইটি ইনচার্জ দেবাংশু ভট্টাচার্যের শেয়ার করা ভিডিয়ো ফুটেজ (যার সত্যতা যাচাই করেনি ‘এই সময়’) দেখিয়ে দাবি করা হয়, ‘ওই দিন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়িতে নয়, পাশে থাকা স্কুটারে ধাক্কা খেয়েই পড়ে গিয়ে ইন্দ্রানুজ আঘাত পেয়েছেন।’ যদিও এসএফআই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য পাল্টা ফুটেজ দেখিয়ে তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।

  • Link to this news (এই সময়)