• ‘বিয়ের পর ছাড়তে হবে খেলা’, শুনেই না টেবল টেনিস খোলেয়াড় শ্রীপর্ণার
    এই সময় | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • সুমন ঘোষ, খড়্গপুর

    ফাইনালে উঠবেন তা ভাবতে পারেননি তিনি। তাই বিয়ের তারিখ রেখেছিলেন ইউএস ওপেন চলার মাঝেই। কিন্তু ফাইনালে ওঠার পর সেই বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়েছিল ইউক্রেনের টেনিস খেলোয়াড় লুদমিলা কিচেনককে। তবে বিয়ে স্থগিত রাখা সার্থক হয়েছিল তাঁর। সেই ট্রফি কিন্তু উঠেছিল তাঁর হাতেই। আর এই দেশের বিয়ের পর খেলা ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল ভারতের অন্যতম সেরা নারী ক্রিকেটার মিতালি রাজকে। কিন্তু ক্রিকেট ছাড়তে নারাজ ছিলেন মিতালি।

    ঠিক তেমনই বিয়ের পর খেলা ছাড়তে রাজি হননি এই বঙ্গের খড়্গপুর শহরের ইন্দা সারদাপল্লির বাসিন্দা টেবল টেনিস খোলোয়াড় শ্রীপর্ণা নন্দ। তিনি জানান, যখনই বিয়ের কথা উঠেছে, খেলা ছেড়ে দিতে হবে বলে পাত্রপক্ষ শর্ত দিয়েছে। তাতে তিনি রাজি হননি। ফলে এখনও বিয়ে করেননি তিনি। খেলার জন্য সব ছাড়তে পারেন। কিন্তু বিয়ের জন্য খেলা ছাড়তে পারবেন না—এমনটাই জানান শ্রীপর্ণা।

    ন্যাশনাল স্কুল গেমসে টেবল টেনিসে বাংলার কোচ হয়ে একগুচ্ছ সোনা এনে দিয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরি করেন। বছর পঁয়ত্রিশে পা দিলেন। কিন্তু বিয়ে করেননি। তাঁর কাছে টেবল টেনিস খেলা ঈশ্বরের মতো। শ্রীপর্ণা সেই ঈশ্বরকে ছাড়তে নারাজ। শ্রীপর্ণা বলেন, ‘পাত্র পেলাম কই? সরকারি চাকরি করেন এমন পাত্র, আবার আইনজীবী, স্কুল শিক্ষক—এমন মিলিয়ে আট জন দেখতে এসেছিলেন। সবাই পছন্দও করেছিলেন। কিন্তু সবাই একই কথা বলেন বিয়ের পর খেলা ছাড়তে হবে। এ সব কথা শুনলে ভাবি আমরা এখনও কোথায় পড়ে আছি। ‘শিক্ষিত’ শব্দটা কোথায় প্রযোজ্য। তাই বিয়ে ভাঙতে বাধ্য হয়েছি। আমার ধ্যান, জ্ঞান টেবল টেনিস। তেমন পাত্র না পেলে সারা জীবন অবিবাহিত থাকতেও রাজি।’

    তাঁর জীবনে বিয়ের সানাইয়ের সুর কাটলেও খেলার সুর কাটতে দেননি এক বিন্দুও। শত বাধা পেরিয়ে খেলতে গিয়েছেন দেশ–বিদেশেও। সে সময়ে তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট টেবল টেনিস খেলোয়াড় ও কোচ সুনীল দত্ত। তাঁর হাত ধরে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে টেবল টেনিসে বাংলা দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন চার বার। ৬৫-৬৮ ন্যাশনাল স্কুল টেবল টেনিসে বাংলার কোচ হয়ে ৭টি সোনা, ১টি রুপো ও ১টি ব্রোঞ্জ জিতিয়েছেন। খড়্গপুর আইআইটি-র জিমখানাতে কোচ হয়েও রুপোর পদক জিতিয়েছেন ভুবনেশ্বরে।

    শুধু কোচ হিসেবেই নয়, খেলোয়াড় হিসেবেও বহু মেডেল জিতেছেন নানা স্তরে। ২০০৮ সালে কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরে ইন্টার স্কুল মিনি অলিম্পিকে অনুর্ধ্ব ১৯ গ্রুপে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ২০০৯ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তৃতীয় স্থান পেয়েছেন। ২০২২ সালে বেঙ্গালুরুতে প্রথম প্যান ইন্ডিয়া সিঙ্গলসে রৌপ্যপদক এবং ডবলসে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। ওই বছর নাসিকে হওয়া দ্বিতীয় ন্যাশনাল মাস্টার্স গেমসে নেমে সিঙ্গলসে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন। ২০২৪ সালের প্যান ইন্ডিয়া মাস্টার্স গেমসে ৩০ ঊর্ধ্ব প্রতিযোগিতায় নেমে সিঙ্গলসে স্বর্ণপদক এবং ডবলসেও স্বর্ণপদক জেতেন। এখন লক্ষ্য, কোচিং এর পাশাপাশি মাস্টার্স প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক স্তরে অংশ নেওয়া ও তাতে সাফল্য অর্জন করা।

    বারো বছর বয়সে তাঁর বাবা শ্রীকুমার নন্দ প্রথম টেবল টেনিসে তাঁকে ভর্তি করেন। ২০০২-০৪ সুনীল দত্তের গ্রীষ্মকালীন কোচিংয়ে অংশগ্রহণ করে সে। ২০১৩ সালে তাঁর হাত ধরে ‘সাই’ থেকে নেতাজি সুভাষ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্কুল সার্টিফিকেট কোর্স করা। ইন্টারন্যাশনাল টেবল টেনিস ফেডারেশন-প্যারা টেবল টেনিস লেভেল ১ কোচ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি। তিনটে বাস পাল্টে ৭০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালতোড়ের এক স্কুলে পড়িয়ে মেদিনীপুরে কোচিং করিয়ে খড়্গপুরে বাড়ি ফিরতে রাত ১০টা বাজত। তবু হাল ছাড়েননি।

    এমন সময়ে দুর্ঘটনায় জমজ ভাইয়ের মৃত্যু হয়। পরের বছরই অকালে মারা যান সুনীল দত্ত। মন ভাঙল। কমলো খেলার গতিও। তারপরে করোনার সময়ে দৌড়তে গিয়ে পায়ে চোট। ভুল চিকিৎসায় পা অসাড় হতে শুরু করে। দু’বছর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল খেলা। চুড়ান্ত হতাশার মধ্যে কিছু বন্ধু খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন। তখনই শ্রীপর্ণার মনে পড়ে সুনীল স্যরের কথা।

    শ্রীপর্ণা বলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর মেদিনীপুর জেলায় টেবল টেনিসকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকেই—বলেছিলেন স্যর। তারপরে থেকেই কলকাতায় সুব্রত দত্তর কাছে কোচিং নিতে যাওয়া শুরু করি।’ শ্রীপর্ণার আক্ষেপ, ‘আমাদের জেলায় খেলার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। যদি তা মিলত তা হলে আমাদের জেলা থেকেও অনেক খেলোয়াড় জাতীয় আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য পেত।’

  • Link to this news (এই সময়)