দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া
পাঁচ বছরে জীবনটাই বদলে গিয়েছে। এই ক’বছরে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে পাঁশকুড়ার দিশা সামন্তের উপর দিয়ে। উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম দিনের পরীক্ষা শেষের পর সে সব কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে হয়ে আসে তার।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাড়ির ছোট মেয়ে দিশার কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। মঙ্গলদ্বারি গ্রামের বাসিন্দা দিশা তখন পাঁশকুড়া গার্লস হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণি। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় পরিবার। চিকিৎসকদের পরামর্শে ওই বছর মার্চে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে দিশাকে দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
চিকিৎসকেরা জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্ল্যান্ট) করা ছাড়া দিশাকে বাঁচানোর কোনও রাস্তা নেই। দিশার সঙ্গী তার বাবা–মা কিডনি দান করতে চাইলেও তাঁদের কারও সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মেলেনি দিশার। আবার নতুন দুশ্চিন্তা! তবে বাবা–মায়ের কাছে এটা জানতে পেরেই বোনকে বাঁচাতে একাই পাঁশকুড়া থেকে দিল্লি রওনা দেন দিদি লিসা। তিনি তখন পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
২০২০ সালে ততদিনে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে কোভিড, লকডাউন। বোনকে নিজের কিডনির অংশ দান করার আগেই কোভিড আক্রান্ত হন লিসা। দিল্লিরই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় লিসাকে। এ দিকে, ক্রমশ শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে দিশার। লিসা কোভিড–মুক্ত হতেই শুরু হয় কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের তোড়জোড়।
২০ মে যখন এ রাজ্যে ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবে সব লন্ডভন্ড, তখন দিশা ও লিসার উপর দিয়েও বয়ে গিয়েছিল অন্য এক ঝড়। লিসার কিডনির ৬০ শতাংশ কেটে বোন দিশা শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সফল ট্রান্সপ্ল্যান্ট শেষে ওই বছর ২১ জুলাই বাড়ি ফিরে আসে সামন্ত পরিবার।
এর পরে শুরু হয় পরের লড়াই। দিশা জানাল, ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর দফায় দফায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় তার। চিকিৎসার পাশাপাশি পড়াশোনাটাও শুরু করে সে। ২০২৩ সালে মাধ্যমিক চলাকালীন পরীক্ষাকেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দিশা। আলাদা ঘরে শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিয়ে ৬৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে দিশা মাধ্যমিক পাশ করে। একাদশে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ভর্তি হয়।
সোমবার দিশা উচ্চ মাধ্যমিকে বসেছে। আগের থেকে শারীরিকভাবে অনেকটাই সুস্থ। প্রথম দিন বাংলা পরীক্ষা ভালই হয়েছে বলে জানায় দিশা। তবে দিদির কথা উঠতেই শ্রদ্ধায় আবেগে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে। বলে, ‘দিদি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। ও আমার কাছে শুধু দিদি নয়। ও আমার কাছে সাক্ষাৎ দেবী। ও না থাকলে আমি আজ এখানে থাকতাম না।’ পরীক্ষার প্রথম দিনে দিদি লিসাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেনি বোন। দিশার দিদি লিসা এখন পিএইচডি করছেন। লিসা বলেন, ‘বোনের মনের জোর আমাকে অবাক করে দিয়েছে। কতটা মনের জোর থাকলে এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!’
দিশার লড়াইকে কুর্নিশ জানাচ্ছে তার স্কুলও। পাঁশকুড়া গার্লস হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রীতা খুটিয়া বলেন, ‘দিশাকে ছাত্রী হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। ওর লড়াই আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে ওর দিদি লিসার অবদানটাও দৃষ্টান্তমূলক। জীবন যুদ্ধে ওরা দু’জনেই সফল।’
উচ্চ মাধ্যমিকের পর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে দিশার। সেই দিশাতেই এগিয়ে যেতে চায় সে, প্রিয় দিদিকে পাশে নিয়ে।