• বাবার মৃত্যুতে ঢুকতে দেরি, বাধা মুছে পরীক্ষা সুজাতার
    এই সময় | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • নীলাঞ্জন দাস, রায়গঞ্জ

    নিয়মের বেড়াজাল টপকে জিতে গেল মানবিকতা।

    পরীক্ষা দিতে না পারার কষ্টে স্কুলের গেটের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। সেখানে তখন অভিভাবকদের গিজগিজে ভিড়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে ২৮ মিনিট দেরি হওয়ার কারণে আটকে দেওয়া হয়েছে তাকে। কেন দেরি হয়েছে তার? প্রশ্ন করলে ছাত্রীটি জানায়, বাবার মৃত্যুর কারণে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হস্টেল থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল সে।

    সোমবার বাংলা পরীক্ষা দিতে আসার পথে ২৮ মিনিট দেরি হয়ে যায় তার। সে কারণে পরীক্ষার প্রথম দিনেই চরম বিপাকে পড়তে হয় ওই পরীক্ষার্থীকে। পুরো বিষয়টি জানার পরে প্রবল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন অভিভাবকরা। শেষ পর্যন্ত কাজ হয় তাতে। চাপের মুখে অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেওয়া হয় সুজাতা হেমব্রম নামের ওই পরীক্ষার্থীকে। সোমবার সকালে ঘটনাটি ঘটে রায়গঞ্জের কর্ণজোড়া হাইস্কুলে।

    উদয়পুর বালিকা বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী সুজাতার বাড়ি করণদিঘির রসাখোয়া পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম জামডাঙ্গায়। ওই স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করলেও ২০২১ সালে বাবার মৃত্যুর পরে বাড়ি ফিরে যায় সুজাতা। মা মাঠে কাজ করে কোনও ক্রমে সংসার চালান। এক ভাই দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। সে নিজেও কষ্ট করে বাড়ি থেকেই স্কুলে যাতায়াত করত।

    এ দিন কর্ণজোড়ার পরীক্ষা কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছনোর জন্য সকাল ৬টায় সাইকেল নিয়ে রওনা হয় সুজাতা। ১ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে রসাখোয়া বাসস্ট্যান্ড পৌঁছয় সে। সেখান থেকে বাসে চাপলেও ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট কেটে যায়। তাড়াহুড়ো করে সে নেমে পড়ে শিলিগুড়ি মোড়ে। পরীক্ষা কেন্দ্রে দিকে যাওয়ার জন্য সেখানেও টোটো পেতে দেরি হয় তার। ফলে নির্ধারিত সময়ের থেকে ২৮ মিনিট পরে উপস্থিত হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে।

    প্রথম দিন ততক্ষণে পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। ফলে গেটের দারোয়ান জানিয়ে দেন, নিয়ম অনুযায়ী তাকে আর পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঘটনার জেরে বিদ্যালয়ের গেটের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সুজাতা। সেখানে উপস্থিত অন্যান্য অভিভাবক ও স্থানীয় কিছু মানুষ ওই অসহায় ছাত্রীর পাশে এসে দাঁড়ান। সকলে মিলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনুরোধ করলেও জানানো হয়, পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী ওই ছাত্রীকে আর পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না।

    এরপর অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দারা সুজাতাকে নিয়ে সোজা শিক্ষা ভবনে চলে যান। সেখানে গিয়ে আধিকারিকদের ওই পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ জানান তাঁরা। এদিকে, ঘটনা জানাজানি হতেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কর্ণজোড়া ফাঁড়ির পুলিশ ও ডিআইবির আধিকারিকরা। সুজাতাকে পুলিশ নিজস্ব গাড়িতে চাপিয়ে ফের পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে আসে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা কাউন্সিলে যোগাযোগ করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুজাতার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি যে সময়টুকু নষ্ট হয়েছে তার নিরিখে অতিরিক্ত সময়ও বরাদ্দ করা হয়।

    স্কুলে উপস্থিত অভিভাবক অসীমা দে সাহা বলেন, ‘আমার মেয়েও পরীক্ষা দিচ্ছে। হঠাৎ দেখি স্কুলের বাইরে ওই মেয়েটি কান্নাকাটি করছে। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা অনেক অনুরোধ করলেও কেউ পাত্তা দেয়নি। পরে সকলে মিলে মেয়েটিকে নিয়ে শিক্ষাভবনে যাই।’ অন্য এক অভিভাবক মুক্তার আলির কথায়, ‘মেয়েটির অনেক দূরে বাড়ি। সেখান থেকে আসতে দেরি হয়েছে গাড়ি সময় মতো না আসায়। ও পরীক্ষা দিতে পেরেছে দেখে ভালো লাগছে।’

  • Link to this news (এই সময়)