• কপালকুণ্ডলা-কথা এবং অবিভক্ত মেদিনীপুর
    এই সময় | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • সুদীপ জোয়ারদার

    ‘কে তুমি যোগিনীবেশে বঙ্কিম নয়নে/ ত্রাণকর্ত্রী ভবানীরে ভাবিতেছ মনে…।’ ১২৭৩ বঙ্গাব্দের ২৬ অগ্রহায়ণ ‘সোমপ্রকাশ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল কবিতাটি। উপলক্ষ, ওই বছরেই প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’। শুধু ‘সোমপ্রকাশে’র এই কবিতা নয়, উপন্যাসের পরিণতিতে খুশি না-হয়ে দামোদর মুখোপাধ্যায় তো ‘মৃন্ময়ী’ নামে আস্ত একটা উপন্যাসই লিখে ফেলেছিলেন।

    সমকালীন সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার বলেছেন, ‘এই উপন্যাসখানি প্রকাশিত হওয়া মাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের যশোরাশি চারিদিকে বিকীর্ণ হয়ে পড়ল…’। আর বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও মনে করতেন, কাব্যাংশে ‘কপালকুণ্ডলা’ খুব উঁচু।

    শুধু সমকালকে আন্দোলিত করা নয় বা লেখকের নিজস্ব মূল্যায়ন নয়, আজও বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ‘গদ্যকাব্য’ হিসেবে ধরা হয় ‘কপালকুণ্ডলা’কে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই উপন্যাসের পটভূমি নিয়ে আজও বিস্তর আলোচনা চলে। তবে এই উপন্যাসের পটভূমি আজ আর কারও অজানা নয়। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখে গিয়েছেন, ‘যে স্থানে নবকুমারকে ত্যাগ করিয়া যাত্রীরা চলিয়া যান, তাহার অনতিদূরে দৌলতপুর ও দরিয়াপুর নামে দুই ক্ষুদ্র গ্রাম এক্ষণে দৃষ্ট হয়।’ মেদিনীপুরের এই দৌলতপুর, দরিয়াপুর কাঁথির মাইল দশেক উত্তর-পুর্বে অবস্থিত। এর কাছেই রয়েছে রসুলপুর নদীর মোহনা।

    মেদিনীপুর জেলার নেগুয়া মহকুমায় বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৮৬০ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত। নেগুয়া কাঁথির সন্নিকটে। বঙ্কিমচন্দ্র নেগুয়া-কাঁথির দু'জায়গার বাংলোতেই ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র লিখেছেন, ‘যখন বঙ্কিমচন্দ্র নেগুয়া মহকুমাতে ছিলেন, তখন সেইখানে একজন সন্ন্যাসী কাপালিক তাঁহার পশ্চাৎ লইয়াছিল, মধ্যে মধ্যে নিশীথে তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিত।’

    বঙ্কিমচন্দ্রের ভাইপো শচীশচন্দ্রের লেখাতেও রয়েছে এই কাপালিকের কথা। শচীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘রাত্রি তখন প্রায় আড়াই প্রহর।…বঙ্কিমচন্দ্র দ্বারে আসিয়া দেখিলেন, একজন দীর্ঘকায় সন্ন্যাসী নরকপাল হস্তে দণ্ডায়মান। তাঁহার আয়ত মুখমণ্ডল, শ্মশ্রুজটা পরিবেষ্টিত, কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা, পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম, ললাটে অঙ্গাররেখা, সর্বাঙ্গে চিতাভস্ম। বঙ্কিমচন্দ্র বুঝিলেন, এ ব্যক্তি কাপালিক। …এই কাপালিক-দর্শনই কপালকুণ্ডলার ভিত্তি।’

    এই কাপালিক দর্শনের সঙ্গে হয়ত মিলেছিল অনতিদূরের সমুদ্র এবং পার্শ্ববর্তী চাঁদপুরের অরণ্যপ্রকৃতির শোভা। দরিয়াপুরে বিগ্রহহীন একটি মন্দির 'কপালকুণ্ডলার মন্দির' হিসেবে স্থানীয় মানুষদের কাছে আজও পরিচিত। মন্দিরসংলগ্ন স্থানে দরিয়াপুরবাসী বঙ্কিম-স্মরণে ১৩২৬ সালে একটা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। সেখানে প্রস্তর-ফলকে দরিয়াপুরকে কপালকুণ্ডলার পরিকল্পানাক্ষেত্র হিসেবে লেখাও রয়েছে।

    ১৮৬০ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় মূলত সরকারি কর্মচারী, লেখক নয়। ‘সংবাদ প্রভাকরে’ দীনবন্ধু মিত্র, দ্বারকানাথ অধিকারীর সঙ্গে ‘কলেজীয় কবিতাযুদ্ধে’ অবতীর্ণ হয়ে পুরস্কার পাওয়া আর ১৮৫৬ সালে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ছাড়া সাহিত্য নিয়ে আর তেমন কোনও ঘটনানেই। বিশেষ করে উপন্যাস-সংক্রান্ত কিছু তো ১৮৬৪ সালের আগে নেই-ই। হয়ত সেই সময়ে তিনি উপন্যাসের সলতে পাকাচ্ছিলেন ও উপাদান সংগ্রহ করছিলেন। মেদিনীপুর থেকে খুলনায় বদলি হয়েও মনের মধ্যে যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র ‘গড় মান্দারণের’ পাশাপাশি ‘কপালকুণ্ডলা’র কাপালিক, দরিয়াপুর-চাঁদপুরের বন, রসুলপুরের মোহনা কিংবা বালিয়াড়ি মনের মধ্যে পাক খেয়ে ফিরেছে, তা বলাই যায়। যাঁকে নিয়ে এই উপন্যাস, সেই কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে বঙ্কিম তো খুলনা-পর্বে রীতিমতো আন্দোলিত।

    তাই দীনবন্ধু মিত্রকে একবার জিজ্ঞেসও করেন, শিশুকাল থকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক বনে কাপালিকের কাছে প্রতিপালিত হলে সে আর সমাজ-সংসর্গে ফিরতে পারবে কি না। কোনটি আগে লেখা শুরু করেন, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাকি ‘কপালকুণ্ডলা’ তা জানা না-গেলেও আমরা দেখি ১৮৬৫ সালে প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের পরের বছরেই প্রকাশিত হচ্ছে, ‘কপালকুণ্ডলা’।

    যে সময়ে ‘কপালকুণ্ডলা’ প্রকাশিত হচ্ছে, মেদিনীপুরের জাতক বিদ্যাসাগর সেই সময়ে পরহিতে নিজেকে বিলিয়ে সারা বাংলাজুড়ে ‘দয়ার সাগর’। আর এই সময়েই দরিয়াপুর-চাঁদপুরের সমুদ্র সংলগ্ন বনে কাঠ কাটতে যাওয়া পরোপকারী নবকুমারকে কেন্দ্র করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন’ উক্তি। এ-ও যেন এক আশ্চর্য সমাপতন! এটি ‘কপালকুণ্ডলা’ তথা বঙ্কিম উপন্যাসের সেরা প্রেরণা-বাক্যও। একই সঙ্গে ওখানকার সমুদ্রের জনহীন প্রান্তরে কপালকুণ্ডলার, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’— এই প্রশ্ন শুধু নবকুমারের উদ্দেশেই আজ আর সীমাবদ্ধ নেই, উপন্যাস ছাড়িয়ে রূপে-রূপকে বহু ব্যবহৃত। দিকভ্রষ্ট মানুষ বা জাতির সম্বিৎ ফেরানোর জন্য নিজের কাছে আজ এ এক সমীচীন জিজ্ঞাসাও।

  • Link to this news (এই সময়)