• ডান্ডায় ঠান্ডা করার নিদান দুই শাসকের
    আনন্দবাজার | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • যাদবপুর-কাণ্ডকে ঘিরে আরও উত্তপ্ত হল রাজ্য রাজনীতি। এক দিকে বাম, অতি বামেদের ‘সবক’ শেখানোর দাওয়াই এবং সেই সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ বা দলের কর্মী-সমর্থক ঢুকিয়ে ‘দখল’ নেওয়ার হুঙ্কার জোরালো হল শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের তরফে। আর কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি দু’পক্ষকেই ‘ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা’ করার তত্ত্ব ফের সামনে আনছে!

    শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়ির ধাক্কায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায়ের জখম হওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজ্য জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল সিপিএম এবং এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন যথাক্রমে এসএফআই এবং ডিএসও। দুই সংগঠনই ধর্মঘটের দিনে রাস্তায় নেমেছিল। পাল্টা ময়দানে নেমেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদও। বেশ কিছু জায়গায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বামেদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, কোথাও কোথাও পুলিশ ও শাসক দলের বাহিনীর যৌথ আক্রমণের অভিযোগও উঠেছে। এরই মধ্যে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ ও প্রাক্তন অধ্যাপক সৌগত রায় যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে বলেছেন, “ছেলেটা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আহত না হলে কেউ সমবেদনা দেখাতেন না। তৃণমূলের দু-তিন হাজার সমর্থক যাদবপুরে ঢুকে গেলে ওঁরা কোথায় বাঁচবেন? প্রেসিডেন্সিতে এক দিন পুলিশ ঢুকল, নকশালেরা পালিয়ে গেলেন! এখানেও তেমন কিছু ভাবতে হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘প্রশাসনিক না রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা মুখ্যমন্ত্রীর স্তরে নেওয়া হবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে, হাজারখানেক পুলিশ ঢুকে যাবে। ওঁরা আসবেন না আর!” যাদবপুরে অতীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় (তখন বিজেপিতে), রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়দের বাধা দেওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ।

    বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ও বামকে এক বন্ধনীতে রেখে লাঠ্যাষৌধি প্রয়োগের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সন্দেশখালিতে গিয়ে সোমবার তিনি ফের বলেছেন, “যাদবপুরের বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী সেকু অর্থাৎ তোষণকারী তৃণমূল এবং মাকু অর্থাৎ যারা ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা তুলতে দেয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেয় না, হিন্দু পরিচয় দিতে দেয় না। এরাই বলেন, ‘নো ভোট টু বিজেপি’। এঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা করে দেন।” ব্রাত্য প্রাণ ভয়ে যাদবপুর থেকে পালিয়েছিলেন বলে দাবি করে শুভেন্দুর মন্তব্য, “বোঝাই যাচ্ছে পুলিশ ছাড়া এঁদের কী অবস্থা হয়! একমাত্র ওষুধ ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করা!” রাজ্যপালের কড়া হস্তক্ষেপ চেয়ে বিরোধী দলনেতার আরও দাবি, ছাত্র সংসদ, ওয়েবকুপা এবং শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে তালা লাগানো উচিত।

    এমন দাওয়াইয়ের প্রেক্ষিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যাদবপুরের প্রাক্তনী সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘আগে দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন এক মিনিটে ঠান্ডা করে দেওয়া যাবে। এখন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরাও বলছেন এক ঘণ্টায় দখল করে নেবেন। বিজেপি বলছে, সব ভেঙে দেওয়া হবে। বিজেপি আর তৃণমূলের একই সুর। নতুন কিছু তৈরির সামর্থ ওঁদের নেই, যা আছে, তাকেও ধ্বংস করতে চান। বাংলার মানুষই এই চেষ্টা রুখে দেবেন।’’

    বারুইপুরে এ দিনই সিপিএমের জেলা দফতরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া, হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বারুইপুর কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার সময়ে কার্যালয়ের ভিতরেই ছিলেন সিপিএম নেতা সুজন-সহ অন্যেরা। অশান্তির খবর পেয়ে পুলিশ এসে টিএমসিপি-র সদস্যদের সরিয়ে দেয়। পরে সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা তালা ভেঙে দেন। ঘটনার প্রতিবাদে সুজন, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়দের নেতৃত্বে এলাকায় মিছিল করে সিপিএম। সুজন বলেছেন, “হামলা, অসভ্যতার অপচেষ্টা দলের কর্মীরাই রুখে দিয়েছেন। ছাত্রদের বিক্ষোভের উপরে গাড়ি চালিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বাহিনী যে অসভ্যতা করেছে, তার অনুপ্রেরণাতেই তৃণমূলের এমন কাজ।’’ তৃণমূল পরিচালিত বারুইপুর পুরসভার উপ-পুরপ্রধান গৌতম দাস পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “কোনও নেতাকেই ঢুকতে দেব না! ব্রাত্য বসুর সঙ্গে যা করা হয়েছে, সেই তুলনায় সিপিএম নেতাদের কিছুই করা হয়নি!”

    এরই পাশাপাশি তৃণমূল ও বামে শুরু হয়েছে ভিডিয়ো-যুদ্ধও। শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির চাকায় ইন্দ্রানুজের জখম হওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে দাবি করেছিলেন, “সিপিএম মিথ্যাচার করছে।” পাল্টা ঘটনার আরও ভিডিয়ো ক্লিপ দেখিয়ে এসএফআই-এর সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এ দিন বলেছেন, “দু’দিন ধরে তৃণমূল মিথ্যা ভিডিয়ো ছড়াচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, তাঁর গাড়ির তলায় এক জন ছাত্র চলে গিয়ে জখম হওয়ায় তিনি দুঃখিত!” ইন্দ্রানুজও দাবি করেছেন, “শিক্ষামন্ত্রীই গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।” এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে জানিয়েছেন, শিক্ষামন্ত্রীর গ্রেফতারির দাবিতে ডাকা তাঁদের ধর্মঘটে তৃণমূল ও পুলিশের ‘যৌথ হামলা’র প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার রাজ্য জুড়ে মাইক ছাড়া বিক্ষোভ দেখানো হবে।

    জখম ইন্দ্রানুজের সঙ্গে এ দিন দেখা করে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) ছাত্র সংসদের নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এবং আচার্য ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাতের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেছেন, “শিক্ষার আঙিনায় রক্তপাত কাম্য নয়। সরকার ও উপাচার্যকে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী, রাজ্যপালকে এগিয়ে আসতে হবে। ধৈর্য সহকারে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।” আর প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের দাবি, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যে পুলিশকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তারা ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করতে নেমেছে। তৃণমূলও রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে বিরোধীদের উপরে হামলা করছে।’’

    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নৈরাজ্যে’র অভিযোগ তুলে ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার ডাকে এ দিন গোলপার্ক থেকে মিছিল করেছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মোর্চার রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁ-র দাবি বলেছেন, “নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সামনে আসা মাত্রই নজর ঘোরাতে বাম-অতি বামেদের দিয়ে পরিকল্পনা করে এই ঘটনা ঘটানো হল।” কার্যত একই সুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বলেছেন, “হিন্দু ভোট ভাগ করতে সিপিএমকে তোল্লাই দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)