• পঁচানব্বইয়েও সঙ্গী বাঁশি আর প্রিয় সাইকেল
    এই সময় | ০৪ মার্চ ২০২৫
  • সুমন ঘোষ, খড়্গপুর

    পরনে আদ্দিকালের ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে কালো পুরু ফ্রেমের চশমা। পাঞ্জাবির বুক-পকেটে যত্ন করে রাখেন একটি কলম। তারপরে বেরিয়ে পড়েন তিনি। গ্রামের মেঠো পথ ধরে তরতরিয়ে এগিয়ে চলে মাস্টারমশাইয়ের সাইকেল। বয়স ৯৫। কিন্তু এখনও তিনি তরতাজা যুবক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড়ের আসনদা গ্রামের কৃত্তিবাস মণ্ডলকে ‘মাস্টারমশাই’ বলেই চেনে তামাম এলাকা। কিন্তু এই বয়সে...। কথা শেষ না-হতেই মুচকি হাসেন কৃত্তিবাস, ‘বয়স? সে তো একটা সংখ্যা মাত্র!’

    কৃত্তিবাসের জন্ম পরাধীন ভারতের মেদিনীপুরে। সালটা ১৯৩০। বয়স বাড়লেও স্মৃতিশক্তি টোল খায়নি এতটুকু! অনায়াসেই মনে করতে পারেন শৈশবের কথা। দীর্ঘ জীবনের পরতে পরতে দেশ–কাল বদলের ঢের অভিজ্ঞতা জমা রয়েছে। মাস্টারমশাই স্মৃতির পাতা উল্টে চলেন, ‘গ্রামের রাস্তায় তখন সাঁজোয়া গাড়ি ছুটছে। চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। বাবা গ্রাম থেকে বাইরে বেরোতে দিতেন না।’

    গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া শেষ করে প্রাইভেটে আইএ পাশ করেন কৃত্তিবাস। বিএ-তে ভর্তি হয়েও পরীক্ষা না-দেওয়ায় পাশ করা হয়নি। নাম লেখান গ্রামীণ যাত্রাপালায়। তখন যাত্রায় ‘ফিমেল’ সাজতে হতো ছেলেদের। অভিনয়ের শখে তিনি ‘ফিমেল’, মানে নায়িকা সেজেছেন বহু বার। তিনি বলেন, ‘সে যাত্রাপালার নাম ছিল—‘বৌদির বিয়ে।’ শুধু ফিমেল সাজা নয়, নায়কও হয়েছিলেন ‘আগুনের শিখায় আজগর আলি’ যাত্রাপালায়। যাত্রার সুবাদে তবলা, হারমোনিয়াম, খোল-করতাল থেকে বাঁশি— সবই শিখে ফেলেছিলেন।

    তিনি আবার ছড়া বাঁধতেও জানেন। যাত্রার শখকে জিইয়ে রেখেই গ্রামেরই আসনদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন কৃত্তিবাস। সেই থেকেই ‘মাস্টারমশাই’।কৃত্তিবাস বলেন, ‘তখন ৫০ টাকা বেতনের চাকরি। সাড়ে সাত টাকা ডিএ। ১৯৯০ সালে অবসর। শেষ বার বেতন পেয়েছি ২০৩৫ টাকা। পেনশন ছিল ১৬০০ টাকা। এখন পেনশনের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার টাকা।’

    বদলেছে জীবনের অনেক কিছুই। কিন্তু তাঁর পুরোনো বাহন সাইকেলটাকে এখনও ছাড়তে পারেননি। বাড়িতে মোটরবাইক থাকলেও সাইকেলটাই আঁকড়ে রেখেছেন কৃত্তিবাস। এই ৯৫ বছর বয়সেও পায়ের চাপে দিব্যি ছুটতে থাকে বাহন। চার ছেলেই রোজগেরে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নিজে এখনও বেলদা বাজারে মনিহারি দোকান চালান। সাইকেলেই যাতায়াত করেন। অবসরে ফু দেন শখের বাঁশিতে।

    মাঝেমধ্যে উদাস দৃষ্টিতে কৃত্তিবাস বলেন, ‘সব কিছুই হলো, কিন্তু এখন আর কথা বলার মতো আমার বয়সি তেমন কাউকে খুঁজে পাই না।’

    একা লাগে? ফের সেই হাসি, ‘নাহ্, এই তো বাঁশি আছে। সাইকেল আছে। হাতের তালুর মতো চেনা মাঠ, ঘাট, প্রান্তর আছে। ওদের সঙ্গেই কথা বলি।’

    বেলা পড়ে আসে। ফের গড়িয়ে চলে কৃত্তিবাসের সাইকেল। দূরে গলির বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ভেসে আসে— ক্রিং...ক্রিং...। সাইকেলের ঘণ্টি। নাকি, সময়ের দীর্ঘশ্বাস?

  • Link to this news (এই সময়)