পিনাকী চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার
আলিপুরদুয়ারে রাজ্যের প্রথম বই গ্রাম পানিঝোরা ইতিমধ্যেই সবার নজর কেড়েছে। কিন্তু প্রায় ‘ব্রাত্য’ হতে চলা বইয়ের কদর ফের বাড়াতে এক অভিনব উদ্যোগ নিলেন আলিপুরদুয়ার কলেজের অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জ্যোতিবিকাশ নাথ। তাঁর স্ত্রী বন্দনা নাথও জীবন বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। ওই শিক্ষক দম্পতি তাঁদের একমাত্র পুত্র ঋষিপ্রতিমের বউভাতে প্রত্যেক আমন্ত্রিতদের হাতে তুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ও নৈবেদ্য। একসময়ে বিয়ে বাড়িতে বই উপহার দেওয়ার খুব চল ছিল। বর্তমানে তা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। সেই পুরোনো প্রথাকে অন্য ভাবে ফিরিয়ে আনলেন শিক্ষক দম্পতি। উপহার হিসেবে বই নয়, উপহার দিতে আসা মানুষজনকে বই তুলে দিয়ে সবার কুর্নিশ আদায় করে নিলেন এই প্রবীণ দম্পতি।
তবে এই বই জোগাড় করতে কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘আমি এক বছর আগে থেকে কলকাতার পাবলিশার্স থেকে শুরু করে বই মেলা ঘুরেও ৪৫০টি গীতাঞ্জলি ও নৈবেদ্য জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষে শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দকে দিয়ে আমাকে সংখ্যা মেলাতে হয়েছে। ভাবা যায় রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টিগুলি নিয়ে মানুষের মধ্যে চাহিদা এতটা তলানিতে ঠেকেছে। অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে আমরা কোন পথে হেঁটে চলেছি?’ তাঁর সংযোজন, ‘মানুষ আজকাল মোবাইলে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, বইয়ের পাতা উল্টানোর দিকে আগ্রহ কিংবা সময় কোনওটাই মানুষের হাতে নেই। বাঙালির হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের মূল্যকে বজায় রাখতে আমি গীতাঞ্জলি ও নৈবেদ্য সবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ২৫০টির বেশি রবীন্দ্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এটাই আমার অবাক হওয়ার সব থেকে বড় জায়গা।’
ওঁদের একমাত্র ছেলের রিসেপশনে আমন্ত্রিত ছিলেন ৪৫০ জন। যাঁদের প্রত্যেকের হাতে জ্যোতিবিকাশ তুলে দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই অমোঘ সৃষ্টি। আমন্ত্রিতদের হাতে বই উপহার হিসেবে তুলে দিতে তাঁর খরচ হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। আলিপুরদুয়ার শহরের পুরানো বাজার এলাকায় ঋষিপ্রতিম ও তানিয়ার রিশেপসনে খাবার খেতে বসে বই উপহার পেয়ে চমৎকৃত হন প্রত্যেকেই। দেবনাথ দম্পতির পুত্র একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এক বিখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি পেয়েও মায়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ওই লোভনীয় চাকরিতে যোগ না দিয়ে কম্পিউটারের ব্যবসা করছেন।
বউভাতের আসরে বই উপহার পাওয়ায় আপ্লুত ফালাকাটা যাদবপল্লি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অভ্রজ্যোতি গুহ। তিনি বলেন, ‘খাবার পাতে বই পরিবেশন হচ্ছে। ভাবলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সঙ্গে সমাজের কাছে ওই অভিনব উদ্যোগ একটা বড় শিক্ষাও বটে। কারণ মানুষের অবহেলায় বই আজকের সমাজে মূল্য হারিয়ে ফেলেছে।সবাই মোবাইলে এক ক্লিকে দরকার পড়ে নিচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে জ্যোতিবিকাশ নতুন বইয়ের গন্ধ উপহার দেওয়ার যে উদ্যোগ নিলেন, তা এক কথায় অভিনব ও অভূতপূর্ব।’