সুদীপ দত্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’। তাঁকে অনুসরণ করে লেখাই যায়, বাঁক বদল অথবা ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার গল্প। এই গল্প উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের ‘দাগ’ পত্রিকার সম্পাদক মনোনীতা চক্রবর্তীর। গল্পের সূত্রপাত ২০১১-য়। সে বছরই আত্মপ্রকাশ করে ‘দাগ’। মনন-মেধায় পাঠকের প্রশংসা কুড়োয় এই নবজাতক। ২০১১ থেকে ২০২৫। দীর্ঘ চোদ্দ বছরে মনোনীতার চিন্তার আঙ্গিক বদলেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, সমাজে যে বিভিন্ন স্তরে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছেন, তাঁদের কত জনের কথা আমরা জানতে পারি? জানতে কি আদৌ পারি তাঁদের লড়াই, শ্রম,ঘাম আর প্রেমের অভিঘাত আসলে বহুবর্ণ জীবনকে কী ভাবে আলোড়িত করে? পারি না। যাঁরা আলোর বিপরীতে থেকে কাজ করে চলেছেন, তাঁরা কেন ব্রাত্য হবেন? কেন তাঁরা হারিয়ে যাবেন সময়ের অন্ধগর্ভে? আমাদের কি কোনও দায় নেই এ সব সম্পদকে রক্ষা করে সবার সামনে তুলে ধরার?
তিনি নিজেও তো একজন সম্পাদক। এবং একজন নারীও। তিনিই বা কেন এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন? এই প্রসঙ্গে মনোনীতা বলছেন, ‘খুব গোপনে অথবা সশব্দে যে সব নারীরা পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন বা রেখে চলেছেন সেই সব নারীদের সবার সামনে তুলে ধরার ইচ্ছে এক সময়ে অদম্য হয়ে ওঠে। আমি রূপান্তরকামী নারীদেরও একই পঙক্তিতে রাখছি। যাঁরা বায়োলজ়িক্যাল অন্য শরীর পেলেও, প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ছাপ রেখেছেন, তাঁদের কথাও তুলে আনা দরকার।’ এমনটাই মনে মনে ভেবে তিনি শুরু করেন উত্তরবঙ্গের নারীদের নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে কাজ করা। তাঁর কথায়, ‘অন্তরের তাগিদ থেকে এই কাজ আমারও নতুন করে পথ চলা।’ এরই ফসল হিসেবে ২০২১-এ প্রকাশিত হয় ‘দাগ’–এর ‘নারী সংখ্যা’। সম্পাদকের কথায়, ‘নারী উৎসব’।
এই সংখ্যায় ১১৩ জন বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারী নিজেদের কথা লিখেছেন হৃদয় খুঁড়ে, স্মৃতি দুমড়ে-মুচড়ে। সাহিত্য জগতের পাশাপাশি মনোনীতা এই সংখ্যায় সমান সম্মান দিয়েছেন শান্তি মুন্ডা (কমিউনিস্ট নেত্রী), রঙ্গু সৌরিয়া (পাচার হয়ে যাওয়া নারী ও শিশুর উদ্ধারে যুক্ত), নবনীতা উপাধ্যায় (পশুপ্রেমী যিনি ‘সর্পকন্যা’ নামে পরিচিত), মিনু বর্মন (মহিলা অ্যাথলিট), অ্যানি দত্ত ( নৃত্যশিল্পী), আর্যমিত্রা চক্রবর্তী (কোভিড ওয়ারিয়র), লক্ষ্মী লিম্বু কৌশল (উত্তরবঙ্গের প্রথম মহিলা টি-প্লান্টার)-সহ অনেক অজানা নারীকেও।
সংখ্যাটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের নারীরা কলম ধরেছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশের নারী অক্ষরশিল্পীরাও। ২০২২ -এও ‘দাগ’- এর নারীদের নিয়ে কাজ করার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়নি। সে বছর পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘উত্তরবঙ্গের নারী নদী আদিবৃক্ষ এবং’। ২০২৩- এ প্রকাশিত হয় ‘সন্দীপ দত্ত স্মরণ সংখ্যা’। ২০২৪- এ ‘অভয়া কান্ড’- র প্রতিবাদে মনোনীতা প্রকাশ করেন ‘আগুনের স্বরলিপি’ সংখ্যা। সম্প্রতি আবার বাঁকবদল- ‘ডাকঘর সংখ্যা’। নারীর লড়াইয়ের সহযোদ্ধা মনোনীতার ‘হাতে তরবারি’ নেই। সাধারণ মানুষের ভিড়ে আলাদা করে তাঁকে চেনাও যায় না। সম্বল বলতে শুধু ব্যতিক্রমী বাঁকবদলের ইচ্ছেশক্তি। কিন্তু, এই ‘উত্তরকন্যা’–র সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে নীললোহিত হয়তো আবারও লিখতেন, ‘তোমার তুলনা তুমি’।