দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে নদিয়ার রানাঘাটের অস্মিকা দাসের কথা এখন অনেকেরই জানা। বিরল রোগে আক্রান্ত এক বছরের ওই শিশুকন্যাকে বাঁচাতে এগিয়ে রূপম ইসলাম, শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৈলাস খেরের মতো শিল্পীরা। এখনও পর্যন্ত তার চিকিৎসার জন্য জোগাড় হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। আগামী চার মাসের মধ্যে প্রয়োজন আরও ১২ কোটি। সেই একই বিরল রোগ বাসা বেঁধেছে বাঁকুড়ার সিমলাপালের অড়রা গ্রামের বাসিন্দা মনোজ হাতির শিশুপুত্র ঈশানের শরীরে।
ন’মাসের এই শিশু স্পাইনাল মাসক্যুলার অ্যাট্রোফিতে (এসএমএ টাইপ-১) আক্রান্ত। তাকে বাঁচাতে প্রয়োজন বিশেষ জিন থেরাপির। যার খরচ প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। কীভাবে হবে এই চিকিৎসা, এ নিয়ে আতান্তরে পড়েছে পরিবার। চিকিৎসার জন্য বিপুল অর্থ জোগাড় করতে ঈশানের পরিবার, আত্মীয়, গ্রামবাসী সকলে একযোগে সাহায্য প্রার্থনা করছেন বিভিন্ন মহলে। সিআরপিএফ জওয়ান মনোজ বর্তমানে মণিপুরে কর্মরত। সেখান থেকেই ফোনে জানালেন, তিন মাস বয়স থেকেই অসুস্থ হতে শুরু করে তাঁর ছেলে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় হাত-পা নাড়ানো।
বাঁকুড়ায় ডাক্তার দেখানো হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় ভেলোর ও চেন্নাইয়ে। সেখানে চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের জন্য করা হয় নানা ধরনের পরীক্ষা। মনোজ বলেন, ‘সপ্তাহ দু’য়েক আগে ভেলোরে করা টেস্টের রিপোর্ট হাতে এসেছে। তাতেই আমরা জানতে পারি যে ঈশান আক্রান্ত এসএমএ, টাইপ-১ রোগে।’ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ভেলোর, চেন্নাই থেকে ফেরার পর বাড়িতেই ছিল ঈশান। গত রবিবার অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভর্তি করা হয় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আপাতত সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছে সে। মনোজ জানান, তাঁর ছেলেকে বাঁচাতে জিন থেরাপি তো প্রয়োজনই। কিন্তু আপাতত মাসে একটি করে সিরাপ খাওয়াতে হবে। প্রতি মাসে যার খরচ ছয় লক্ষ টাকা। এই অবস্থায় অথৈ জলে পড়েছেন মনোজ। তাঁর কথায়, ‘ইতিমধ্যে গত কয়েক মাসে ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তার জন্য ধারদেনাও হয়েছে। এখন এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আমার একার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই সকলের সহযোগিতা চাইছি। রাজ্য সরকারের কাছেও আমার কাতর আবেদন, ছেলেকে বাঁচান। পাশে দাঁড়িয়ে সবাই সাহায্য করলে তবেই নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে ঈশান।’ জানা গিয়েছে, ঈশানের চিকিৎসার খরচ তুলতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে এলেও যে পরিমাণ টাকা উঠছে তা যথেষ্ট নয়। ক্রাউডফান্ডিংও করা হচ্ছে।
একরত্তির এই বিরল রোগে আক্রান্তের কথা শুনেছেন সিমলাপালের তৃণমূল বিধায়ক ফাল্গুনী সিংহবাবু। বিধায়ক বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। ব্যক্তিগত ভাবেও বিভিন্ন মানুষকে অনুরোধ করছি সাহায্যের জন্য। স্থানীয় স্তরে অনেকে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন। এ ছাড়া সরকারি ভাবেও যদি কোনও সহযোগিতা পাওয়া যায়, তার জন্য আমি বাঁকুড়ার সাংসদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রয়োজনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলব। আমরা প্রতিনিয়ত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি।’ স্পাইনাল মাসক্যুলার অ্যাট্রফি রোগটি আসলে কী? চিকিৎসকরা জানান, স্পাইনাল মাসক্যুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) একটি জেনেটিক রোগ। এটি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের মোটর নিউরোন স্নায়ু কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
হাত, পা, বুক, গলা, মুখ ও জিভের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে মোটর নিউরোন। সেই সঙ্গে পেশির নড়াচড়া যেমন হাঁটা, কথা বলা, গিলতে ও শ্বাস নেওয়া নিয়ন্ত্রণ করাও এই মোটর নিউরোনের কাজ। বয়স বাড়ার সঙ্গে বুদ্ধির বিকাশ ঘটলেও স্নায়ুর বিকাশ ঘটবে না। জানা গিয়েছে, ঈশান যেহেতু এসএমএ টাইপ–১ আক্রান্ত তাই তার পেশি দুর্বল হয়ে যাবে, কথা বলতে, খাবার গিলতে ও শ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দেবে। কী ভাবে হয় এই রোগ? জানা গিয়েছে, বাবা-মায়ের থেকেই শিশুর শরীরে আসে এই জিনবাহিত রোগ। বাবা-মা দু’জনেই ‘সারভাইভ্যাল মোটর নিউরোন’ জিনের বাহক হলে সন্তান এসএমএ-তে আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসার উপায় কী? চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই রোগের জন্য দরকার জিন থেরাপির। যার জন্য রয়েছে জোলগেনস্মা নামে একমাত্র কার্যকরী ইনজেকশন৷ যার দাম প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। বর্তমানে এটি ভারতে অমিল। আমেরিকা থেকে এই ইনজেকশনটি এনেই বাঁচানো সম্ভব ছোট্ট ঈশানকে।