• মহল্লার ভালোবাসাই ফেরাল সনিয়াকে, কুর্নিশ পুলিশকে
    এই সময় | ০৫ মার্চ ২০২৫
  • সৌমিত্র ঘোষ, বালি

    ছ’বছরের সনিয়ার মা মারা যান তার জন্মের দিন কয়েক পরেই, ট্রেনে কাটা পড়ে। বাবা এবং নাবালক দাদা ভোর হলেই বেরিয়ে যান রুজি–রুটির সন্ধানে। কিন্তু তাতে কী! ছোট্ট সনিয়াকে আগলে রাখার মানুষের অভাব নেই তার মহল্লায়। বেলুড় স্টেশন সংলগ্ন সুভদ্রা নগরের সব পরিবার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তার দায়িত্ব।

    কিন্তু সেই সনিয়াই হঠাৎ হারিয়ে গেল গত শুক্রবার।পুলিশের তৎপরতায় নিখোঁজ হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করা হলো তাকে। সুভদ্রা নগরের বাসিন্দা শিশুটির শুক্রবার বেলা ১১টার পর থেকে আর খোঁজ মিলছিল না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশুটি সম্ভবত বেলুড় স্টেশন থেকে কাটোয়া লোকালের কোনও অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বগিতে উঠে কাটোয়া পৌঁছে গিয়েছিল। সুভদ্রা নগরের এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশুটির মা না–থাকায় এবং বাবা ও দাদা কাজে বেরিয়ে যাওয়ায় মহল্লার অন্য পরিবারের সকলেই তার খেয়াল রাখেন ও তাকে খাওয়ানোর কাজও করেন।

    ফলে গোটা মহল্লাটাই একপ্রকার শিশুটির বাড়ি। বেলুড় স্টেশনের গা ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের মহল্লা, সুভদ্রা নগর। এলাকাটি বালি গ্রামাঞ্চলের মধ্যে। দুরন্ত শিশুর সারাদিনের দৌড়ে বেড়ানোর ট্র্যাক বেলুড় স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। নাম তার সনিয়া দাস। বয়স মাত্র ছয়। শিশুটি কোনও স্কুলে যায় না। তবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তত্ত্বাবধানে তাঁদের পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রেই চলছে তার অ, আ, ক, খ, এবিসিডির তালিম। সেন্টারের দিদিদের আদরের কোলে–পিঠেই তার লেখাপড়া–খেলা— সব।

    শিক্ষিকারাই তাকে স্নান করিয়ে, খাবার খাইয়ে পড়তে বসান। কারণ, ওর মা নেই যে! জন্মের কিছু দিন পরেই একদিন ওর মায়ের মৃত্যু হয় ট্রেনে কাটা পড়ে। এখন বাবা আছেন, আছে দাদাও। তবে দু’মুঠো জোগাড় করতে সারাদিন বাড়ি থেকে দূরে–দূরে খাটনির কাজে তাঁদের দিন চলে যায়। পাড়ার দিদি, কাকি, জেঠিদের কাছেই তার সারাদিন কাটে। বাকিটা স্বেচ্ছাসেবী কেন্দ্রে। সুভদ্রা নগরের সব ঘরেরই দুয়ার খোলা সনিয়ার জন্য। আর তাঁদেরই কেউ না কেউ তাকে দুপুরের খাবারটা মুখে তুলে দেন ঠিক। সেন্টারের অধিকর্তা পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ও আমাদের কাছে খুব স্পেশ্যাল। খুব আদরের।’

    দিন চারেক আগে আচমকা জানা যায়, সনিয়া নিখোঁজ। বেলা ১১টা থেকে তাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। খবরটা কানে আসতেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন সেন্টারের সবাই। কোরাসের বেলুড় সেন্টারের শিক্ষিকা, সমাজকর্মী সুস্মি আর তন্দ্রালি ও প্রাক্তন ছাত্র সুকুমাররা পাড়ার লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। খবর যায় নিশ্চিন্দা থানাতেও। থানার বিশেষ টিম তৎপরতার সঙ্গে দ্রুত চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করেন।

    পার্শ্ববর্তী জেলার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গত শনিবার সকালে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় সনিয়ার খোঁজ পেয়ে যান তদন্তকারীরা। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিন্দা থানার আধিকারিক, কর্মীরা সনিয়াকে খুঁজে বের করেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থানীয়রা কাটোয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে শিশুটিকে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে দেখে, তাকে কাটোয়া থানায় নিয়ে যান। শনিবার নিশ্চিন্দা থানার তদন্তকারী দল গিয়ে কাটোয়া থেকে সনিয়াকে বালিতে নিয়ে আসেন। স্থানীয় মানুষ ও কোরাসের পক্ষ থেকে পুলিশের ভূমিকাকে কুর্নিশ জানানো হয়েছে।

  • Link to this news (এই সময়)