তৃণমূলে মিলায় বাম-অতি বাম! যাদবপুরের অস্বাভাবিক এই ‘সন্ধি’ থাকবে কতদিন?
প্রতিদিন | ০৬ মার্চ ২০২৫
রমেন দাস: বাংলা থেকে বাম সূর্য অস্ত গেছে ২০১১ সালে। এক দশক পরে এ রাজ্যে তাদের উপস্থিতি মহাশূন্য! সেই অনন্ত শূন্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কি এক অলৌকিক লাল ‘গ্রহ’? নতুন করে এই প্রশ্ন উঠেছে সাম্প্রতিক ঘটনায়। গত ১ মার্চ ওয়েবকুপার বার্ষিক সাধারণ সভার দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সরব হয় বাম ছাত্র সংগঠনগুলি। উত্তপ্ত বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে আহত হন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। আহত হন বিক্ষোভকারী এক ছাত্রও। এই ঘটনার পর অন্তর্কলহে ক্ষান্ত দিয়ে কলরব শুরু হয়েছে। আন্দোলনের আঁচে পুড়ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পাঁচিলঘেরা ৬০ একরের জমিতে জোটবদ্ধ হয়েছে বাম ও অতি বাম। যদিও প্রশ্ন উঠছে, এই ‘সন্ধি’ কতদিন অটুট থাকবে?
বাংলায় ছাত্র আন্দোলনের ঝকঝকে ইতিহাস রয়েছে। তথাকথিত ‘অগ্নিযুগে’র বিপ্লবীদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে বাম-কংগ্রেসের সংগঠনের অন্যতম শক্তি ছিল কলেজে পাঠরত মেধাবী ছাত্ররাই। পরবর্তীকালে নকশাল আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সকলের জানা। সেই ভূমিকায় এমনকী রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। যদিও আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাম ছাত্র আন্দোলনে দ্বিচারিতার কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ সেখানে বছরভর সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সঙ্গে অন্য বাম সংগঠনগুলির সরাসরি বিরোধিতা দেখা যায়। খটামটি লেগেই থাকে এআইএসএ, আরএসএফ, এআইডিএসও-র মধ্যে। তারাই আবার প্রয়োজন মতো নিজেদের মধ্যে শান্তির পায়রা ওড়ায়। কেন?
যখন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কিংবা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) যাদবপুরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, তখনই একে অপরের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোড়াছুড়ি, মারামারি থামিয়ে একজোট হয় বাম ও অতি বাম। অনেকের বক্তব্য, ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনের সময় যারা একে অপরের বিরুদ্ধে হুমকির রাজনীতি করে, এমনকী রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা বোধ করে না, তারাই ভোল বদলে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য তৈরি করে ক্যাম্পাসে দখলে রাখার রাজনীতি চালায়। সম্ভবত এবিভিপির তুলনায় তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে অধিক চিন্তিত বাম ও অতিবাম। কারণ ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে ছাত্রদের মধ্যে প্রভাবকে যদি নিক্তিতে মাপা যায়, তা হলে পদ্মশিবিরের তুলনায় তৃণমূলের প্রভাব, দৃশ্যমানতা অনেকটাই বেশি। সম্প্রতি ব্রাত্য বসুর গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়াও কি সেই কারণে?
এমনিতে বাম ও অতি বামের ‘ভালোবাসা’ ও ‘ঘৃণা’ আসলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সেই কারণেই প্রশ্ন উঠছে, যাদবপুরের অস্বাভাবিক ‘সন্ধি’ কতদিন টিকবে? এই বিষয়ে এআইএসএ-র কার্যকরী কমিটির সদস্য শঙ্খদীপের বক্তব্য, “আমরা জোটবদ্ধভাবে ছাত্র আন্দোলনে নেমেছি। যতক্ষণ না পর্যন্ত ১ মার্চের ঘটনার বিচার পাব, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।” বাম ও অতি বামের সংঘাত স্বীকার করে শঙ্খদীপ বলেন—“সময়ের দাবি ও পরিস্থিতির চাহিদার উপর সমীকরণ তৈরি হয়।”
বাম সংগঠনগুলির ঐক্য নিয়ে আরএসএফ সদস্য উজান বলেন, “ইন্দ্রানুজের উপরে যেভাবে তৃণমূলের গুন্ডাদের হামলা নেমে এসেছে, সেখানে আমরা বিভাজনের রাজনীতির কথা বলছি না। এটা সমগ্র যাদবপুরের উপরে আক্রমণ।” তবে এসএফআইয়ের সঙ্গে মতাদর্শগত পার্থক্যের কথাও জানান উজান। অর্থাৎ, পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষের ঐক্য ভাঙতেই পারে। লাল ভেঙে ফিকে লাল ও গাঢ় লাল আলাদা হতেই পারে। বাম দলগুলির রাজনৈতিক মতবিরোধের কথা স্বীকার করলেন এআইডিএসও-র নেতা শুভাশিস জানাও। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর আক্রমণ এলে আমরা একজোট হব। আন্দোলনের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।”
এই বিষয়ে এসএফআইয়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক কমিটি সভাপতি তমোলিনা ঘোষের বক্তব্য, “ডানপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তি যখনই মাথাচাড়া দিয়েছে, তখনই বামপন্থী দলগুলি নিজের মধ্যের মতাদর্শগত বিভেদ মুছে একজোট হয়ে আন্দোলন নেমেছে।” যদিও সংসদ নির্বাচন অবধি এই জোট টিকবে এমন গ্যারান্টি দিচ্ছেন না কোনও বাম ছাত্র সংগঠনই। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও কেন যাদবপুরে হুল ফোটাতে পারছে না এবিভিপি কিংবা তৃণমূল?
এই বিষয়ে এবিভিপির দক্ষিণবঙ্গ সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকারের বক্তব্য, “নকশালপন্থী বাম অতি বাম সংগঠনগুলি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।” যাদবপুরে অতি বামেদের দৌরাত্ম্য, সাম্প্রতিক উত্তেজনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি কিশলয় রায় বলেন, “আমরা হিংসার রাজনীতি করি না।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বামেদের নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অদক্ষতা, এমনটাও জানালেন কিশলয়। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে খুন হলেও বোঝা যাবে না। সিসিটিভি নেই। নেশাভাঙ চলে ক্যাম্পাসে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য জুটা এদের কাজে লাগায়। সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়।” সাম্প্রতিক ঘটনায় তৃণমূলের ছাত্র নেতার প্রশ্ন, “একটি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী যেতে পারবে না? তাঁকে হেনস্তা করা হবে? তাঁর গাড়ি ভাঙচুর হবে? আমরা না থাকলে তাঁর প্রাণ সংশয় হতে পারত।”
অতএব, সন্ধি যে সাময়িক তা স্পষ্ট। ‘কলরব’ থেকে ‘কলহ’ বেশি দূরে নয়। হাতে থাকল ছাত্র আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, বাংলাদেশের মতো হিংসাত্বক ছাত্র আন্দোলন হবে না তো এই বাংলাতে? তৃণমূলের ছাত্রনেতা কিশলয় অবশ্য বলছেন, “ওরা আর জি করের সময় এই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এটা বাংলাদেশ নয়। এটা ভারতবর্ষ, এটা পশ্চিমবঙ্গ। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে কোনও ষড়যন্ত্র
টিকবে না।”