• ‘জাতীয় ভিলেন’ থেকে যাবেন আওরঙ্গজেব?
    এই সময় | ০৭ মার্চ ২০২৫
  • বইটা লিখে রীতিমতো সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন ইউএসএ–র ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুশকি। শেষ ‘গ্রেট মুঘল’ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘আওরঙ্গজেব, দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ বইটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ আক্রমণের মুখে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। লেখিকা যে আসলে ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং তিনি যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বইটি লিখেছেন, সেটাই সব রকম ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু হয়। দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বরা এমন আক্রমণে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যান।

    কেউ কেউ তো এমন মন্তব্যও করেন যে, মুঘল সম্রাট তাঁর ৫০ বছরের রাজত্বকালে যত না আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে নিউ জার্সির রাটগার্জ় ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপিকাকে। এখানেই শেষ নয়। বইটি বেরনোর কিছু দিন পর হায়দরাবাদে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিনি।

    কিন্তু প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত ওই সেমিনার বাতিল করতে হয়। বিরক্ত ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেন, ‘দিস ইজ় আ ক্লাসিক এগজ়াম্পল অফ হেকলার্স ভেটো ট্রায়াম্ফ ওভার দ্য পারসিউট অফ নলেজ।’ সাদা বাংলায়, হেনস্থাকারীদের হাতে জ্ঞানচর্চার পথ রুদ্ধ হওয়ার এমন প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর হয় না।

    ‘হেনস্থাকারীদের’ হাতে এমন ঘটনার নজির দেশে এটাই প্রথম নয়। প্রায় দু’দশক আগে পুনের স্বনামখ্যাত ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (বোরি) হামলা করেছিল স্থানীয় ‘শম্ভাজি ব্রিগেড’–এর সদস্যরা। সেই সময়ে ইউএস গবেষক জেমস লেন সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ছত্রপতি শিবাজিকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। ব্রিগেডের অভিযোগ ছিল, শিবাজি সম্পর্কে লেনের মন্তব্য অত্যন্ত অসম্মানজনক, সে জন্যই ইনস্টিটিউটকে এমন ‘হাতেনাতে শিক্ষা দেওয়ার’ ব্যবস্থা।

    ‘যাকে আমার ভালো লাগে, তার বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করা চলবে না, আবার আমি যাকে খারাপ বলে মনে করি, তার সম্পর্কে ভালো কথা বলতে দেবো না’ — ঠিক এমন পথেই কি এগোচ্ছে দেশ? অতি সম্প্রতি মহারাষ্ট্র বিধানসভার ঘটনা আরও একবার সেই প্রশ্নই তুলে দিল। কী হয়েছে বিধানসভায়? ওই ঘটনার সঙ্গেও যোগ রয়েছে সেই আওরঙ্গজেব ও শিবাজির সংঘাতের। সদ্য মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘ছাওয়া’–র বিষয়বস্তু শিবাজির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শম্ভাজির সিংহাসনে আরোহণ এবং তাঁর সঙ্গে আওরঙ্গজেবের সংঘর্ষ।

    ওই ছবিতে মুঘল সম্রাটকে রক্তপিপাসু হিসেবে দেখানো হয়েছে। মহারাষ্ট্রের সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আবু আসিম আজ়মি ওই ছবিটি দেখে হল থেকে বেরনোর সময়ে তাঁকে ছবিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। তখন তিনি জানান, মুঘল সম্রাটকে ছবিতে যে ভাবে দেখানো হয়েছে, সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। এই মন্তব্য করার জেরে তাঁকে পুরো বাজেট অধিবেশনের জন্যই বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড করা হয়। বিধায়ক কেন এমন মন্তব্য করেছেন, সেই বিষয়ে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

    এমনকী, তিনি নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে চাওয়ার পরেও তাঁর সাসপেনশন বাতিল হয়নি। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। বিধায়ক নিজের এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও কোনও হুমকি দেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

    যাঁকে নিয়ে এত বিবাদ, সেই মুঘল সম্রাট এবং ‘দ্য লাস্ট গ্রেট মুঘল’ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যদুনাথ সরকারের গবেষণাকে বিশদ ও প্রামাণ্য বলে মনে করে গোটা দুনিয়া। বাঙালি ওই ইতিহাসবিদ তাঁর কাজে কোনও জায়গাতেই আওরঙ্গজেবকে ‘রক্তপিপাসু নরপশু’ হিসেবে উল্লেখ করেননি। বরং, তিনি বিভিন্ন জায়গায় আওরঙ্গজেবকে ‘ট্র্যাজিক নায়ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

    যদুনাথ সরকার জানিয়েছেন, ‘এই মহান ব্যক্তিত্ব’ বৃদ্ধ বয়সেও যে ভাবে ভারতকে একটা বাঁধুনির মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন, সেটা প্রশংসনীয়। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেই সেই সময়ে দেশে কোনও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়নি। যদুনাথের মতে, আওরঙ্গজেবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্যে শুধু সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নয়, আরও বহু কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি ও তাঁর উত্তরসূরিদের অপদার্থতা।

    বাংলার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপকরা জানাচ্ছেন, যদুনাথ সরকারের মতে, আওরঙ্গজেবের আমল তাঁর পূর্বসূরিদের আমলের মতোই ছিল— আলাদা করে ‘বেশি খারাপ’ ছিল না। কিন্তু তা হলে আওরঙ্গজেবকে এমন ভাবে ভিলেন বানানো কেন?

    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহার ব্যাখ্যা, ‘শিক্ষিত লোকজন যে মানসিকতা নিয়ে ইতিহাস পড়তে যান, মৌলবাদীরা তেমনটা করেন না। তাঁরা আগে একটা প্রতিপক্ষ তৈরি করে নেন, তারপর সেই মতো বানিয়ে নেন ইতিহাসকে। আওরঙ্গজেব বহু বছর ধরেই তাঁদের ব্যাড বুকে।’ ইতিহাসবিদরা বলছেন, ‘দক্ষিণ ভারতে চালুক্য ও পল্লব রাজারা বহু বছর যুদ্ধ করেছেন। একপক্ষ শক্তিশালী হয়ে অন্যদের হারিয়ে দেওয়ার পর তাঁদের উপাসনাস্থল ভাঙচুর করার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে।’ তাঁদের প্রশ্ন, তা হলে একা আওরঙ্গজেব দোষী কেন? ভ্রাতৃহত্যা? ভারতের ইতিহাসে তারও বহু উদাহরণ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন ইতিহাসবিদরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘সম্রাট অশোকই তো তাঁর ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন।’

    ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপিকা উর্বী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ইউজিসি–র নতুন শিক্ষানীতি হলো, দেশের অতীতকে মহিমান্বিত করা। ছাত্রছাত্রীরা সত্যিটা জানতে পারল কি না, সেটা কিন্তু উদ্দেশ্য নয়। এ ভাবে ইতিহাস পড়া যায় না। এরা চাইছে ইতিহাস, মিথ, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির একটা বিচিত্র ঘ্যাঁট তৈরি করতে। এই কারণেই বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ করা হচ্ছে। অথচ ইতিহাসের মতো বিষয় সমৃদ্ধ হতে পারে পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমেই।’ উর্বী জানাচ্ছেন, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সময়ে এ দেশের বিভিন্ন মহাফেজখানায় তিনি ঢুকতে পাননি, অথচ দেশে ফিরে অধ্যাপনা শুরু করার পর সেই জায়গাতেই দিব্যি ঢুকে কাজ করেছেন। এ ভাবেই রীতিমতো কৌশলে আটকানো হচ্ছে এক শ্রেণির গবেষককে। ইউএসএ–র ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুশকির মন্তব্য, ‘আমার পরিচিত অনেকেই আর ভারতে কোনও বই প্রকাশ করতে চাইছেন না।’

    ইতিহাসবিদদের অনেকেরই মতে, আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনে তাঁকে জাতীয় ভিলেনে পরিণত করা হয়েছে, সেই অভিযোগ দেশের আরও বহু রাজার বিরুদ্ধেই করা যায়। কিন্তু বাকিদের সযত্নে উপেক্ষা করে আওরঙ্গজেবকেই রবি ঠাকুরের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মতো ‘ধর ধর ওই চোর, ওই চোর’ করা হয়। এর ফলে বিকৃত হয় দেশের ইতিহাসটাই। ৩১৮ বছর আগে মারা যাওয়া মুঘল সম্রাটের তো আর নতুন করে কিছুই যায়–আসে না।

  • Link to this news (এই সময়)