এই সময়: আলটপকা মন্তব্য করে কলকাতা হাইকোর্টকে কলঙ্কিত করেছেন আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় — এই যুক্তিতে তাঁকে কার্যত ভর্ৎসনা করলেন বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শনিবারের ঘটনায় একদিকে পুলিশের অতি–সক্রিয়তা, অন্যদিকে নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছিল হাইকোর্টে।
এ দিন বিচারপতি ঘোষের এজলাসে হাজির হয়ে কল্যাণ জানান, তিনি এই মামলার শুনানিতে রাজ্যের হয়ে সওয়াল করতে চান এবং সে জন্য শুনানি একদিন পিছিয়ে দেওয়ার আর্জিও করেন। তবে এ নিয়ে কথোপকথনের সময়ে কল্যাণ যে সব মন্তব্য করেন, তাতে তিনি আদালতকে ‘ম্যালাইন’ করছেন বলে পর্যবেক্ষণ বিচারপতির। একটা সময়ে কল্যাণ নিজেই হাতজোড় করে জানিয়ে দেন, তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। ভবিষ্যতে শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এই এজলাসে অন্য কোনও মামলা করতেই তিনি আসবেন না।
আইনজীবীদের একাংশের অবশ্য ব্যাখ্যা, এ দিন বিচারপতি ঘোষের অসন্তোষের কারণ শুধুমাত্র কল্যাণের সওয়াল নয়। ঘটনার সূত্রপাত দিনদুয়েক আগে। বিজেপি নেতা অর্জুন সিং তাঁর বিরুদ্ধে করা পুলিশের এফআইআর খারিজের আর্জি নিয়ে এই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সে দিন কল্যাণ মন্তব্য করেন কলকাতা হাইকোর্ট বিরোধীদের করা মামলায় কার্যত ‘পালং শাক কেনার’ মতো মামলাকারীর পক্ষে রায় দিচ্ছে। এ দিন শুনানিতে সেই প্রসঙ্গের সরাসরি উল্লেখ না–করলেও ঘটনাক্রমের দিকে ইঙ্গিত করে কল্যাণ হাইকোর্টকে ‘ম্যালাইন’ করছেন বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি ঘোষ।
যাদবপুরের মামলায় শুনানি আগামী ১২ মার্চের পরিবর্তে একদিন পিছিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান কল্যাণ। যাদবপুরের ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা আগের শুনানিতেই শোনা গিয়েছিল বিচারপতি ঘোষের গলায়। এ দিনও তিনি কল্যাণকে বলেন, ‘আপনি যা–ই যুক্তি দিন, সে দিন পুলিশের দিক থেকে ত্রুটি ছিল।’
কল্যাণের পাল্টা যুক্তি — ‘২০১৪–য় একটি মামলায় হাইকোর্টেরই ডিভিশন বেঞ্চের একটি রায় আছে এ ব্যাপারে। তাই পুলিশকে সীমারেখা মেনে চলতে হয়।’ তাঁর সংযোজন, ‘সে দিন পুলিশ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ত্রুটি হয়েছে। আগামী শুনানিতে সেটা বুঝিয়ে বলব।’ এতে বিচারপতি ঘোষের বক্তব্য, ‘সে দিন মন্ত্রীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল জনতা! তার আগে পুলিশ বাধা দিয়েছিল? তা হলে তাঁর ক’জন পার্সোনাল সিকিউরিটি অফিসার (পিএসও) জখম হয়েছেন, খবর নিন।’ কিন্তু কল্যাণ তার পরেও বলতে থাকেন, ‘এটা নিরাপত্তার গাফিলতি নয়।’ বিরক্ত বিচারপতির প্রশ্ন, ‘তা হলে নিরাপত্তা দেওয়ার দরকার কী? আপনি যা–ই বলুন, পুলিশের দিক থেকে দুর্বলতা ছিল। আমি উদ্বিগ্ন মন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে। আগের দিন অ্যাডভোকেট জেনারেলকেও (এজি) এটা বলেছি।’
কল্যাণের যুক্তি, ‘উনি (শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য) পার্টি মিটিংয়ে ঢুকছিলেন। তখন পিএসও–দের বাইরে রাখা হয়। ওখানেও এটা হয়েছিল।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘হাইকোর্টে লিগ্যাল সেল কোনও মিটিং ডাকলে, সেখানে আমি গেলে যদি এমন হয়, পুলিশ কী করবে?’ যদিও বিচারপতি তা মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। বৈঠকের শেষে বেরিয়ে আসার পরে হয়েছে। উনি একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। প্রোটোকল আছে। তাই কিছুটা তাঁর মানা উচিত। আমি তবু বুঝতাম, যদি ভিড় পুলিশকে ওভারপাওয়ার করে মন্ত্রীর কাছে পৌঁছত। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।’
তখনই কল্যাণের গলায় শোনা যায় কটাক্ষের সুর — ‘এটা প্র্যাকটিক্যাল ভাবনা নয়। এই যুক্তি জাজের ক্ষেত্রে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মতো লোকেদের (রাজনীতিকদের) ক্ষেত্রে প্রোটোকল সব সময়ে মানা সম্ভব নয়।’ এতেই ক্ষুব্ধ হন বিচারপতি ঘোষ — ‘আপনি এমন ভাবে কোর্টের সঙ্গে কথা বলেন... সেটা এমন ভাবে প্রচার হয়, তাতে অন্তত এই কোর্ট নিজেকে ম্যালাইনড (কলঙ্কিত) বলে মনে করছে। কোর্টকে ম্যালাইন করার চেষ্টা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। গঠনমূলক সমালোচনা এক জিনিস। আর ম্যালাইন করা আর এক জিনিস।’
বিচারপতির উষ্মার মুখে কল্যাণ বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে একপেশে খবর দেখানো হলে কিছু করার নেই। আবার (খবরে) ট্রোলডও হতে হয়। আমি দুঃখিত। আমি আর এই কোর্টে মামলা করব না।’ এর পরে হাতজোড় করে আবার বলেন, ‘আমি দুঃখিত। যদি কোর্টকে ম্যালাইন করে থাকি, তা হলে এই কোর্টে আর শুনানির জন্য আসব না।’