কতই বা বয়স তখন। সবে ক্লাস ইলেভেন। শিবরাত্রিতে হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে অবাক ষোড়শী! তাঁদের ছোট্ট বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছিল। কেন? বাবার জবাবে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যান বিভা। আজ বাদে কাল তিলক! চার দিন পরে বিয়ে! ধপ করে বসে পড়েছিলেন। ১৯৮৮–র কথা। সেই বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় সেনা অফিসার স্বামীর মৃত্যুতে বিভা সিংয়ের চোখের সামনে নেমে আসে নিকষ অন্ধকার।
কোলে তখন আড়াই মাসের মেয়ে। ওই অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই বিভা সে দিন নিজের হাতে লিখে নিয়েছিলেন এক সফলতার আখ্যান। স্বামীর মতোই জয়েন করেন আর্মিতে। মেয়ে এখন চিকিৎসক। তবে লড়াই আজও থামেনি। পাটনার মেয়ে হতেই পারেন লড়াইয়ের সেরা বিজ্ঞাপন।
এখন কলকাতায় এসেছেন আমন্ত্রণে। সেনা অতিথি নিবাসে বসে মেলে ধরলেন জীবনের কাহিনি — ‘বিয়ে জিনিসটা কী, তা বোঝার আগেই সাত পাক ঘুরতে হয়েছিল ভাগলপুরের ২১–এর সঞ্জয় সিংয়ের সঙ্গে। ভাগলপুরের দেহাতি ভাষা জানতাম না। মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র সঞ্জয়ের জন্যই। উজ্জ্বল ছাত্র। কম বয়সে লেফটেন্যান্ট হয়েছিলেন। সুখে মোড়া ছিল আমাদের সংসার। ১৯৯১–এর ২৬ জানুয়ারির রাতটা ওলটপালট করে দেয় সব। আমরা তখন অমৃতসরে। ছুটিতে ছিল সঞ্জয়। পাশের ঘর থেকে মাঝরাতে বিভাকে কোনও রকমে ডেকে তোলেন। নাক-মুখ দিয়ে ঘরঘর করে আওয়াজ বের হচ্ছিল। প্রতিবেশীদের সাহায্যে হাসপাতালে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নিস্তেজ।চিকিৎসকদের আর কিছু করার ছিল না।’
শ্রাদ্ধ মিটে যেতে শ্বশুরবাড়ি থেকে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়া হয় বিভাকে। বলেন, ‘বিভাগীয় সব আর্থিক সুবিধা স্বামীর বড়দা নিয়ে নেন। আমার বাপের বাড়ি থেকে যে গয়না দেওয়া হয়েছিল, তাও নিয়ে নেন। শাশুড়ি–মা বলেছিলেন, ভেবে নাও ওটা তোমার স্বামীর শ্রাদ্ধের খরচ।’
বাপের বাড়িতে ফিরে বাবার কথায় বছর খানেক পরে আবার পড়াশোনা শুরু। মেয়ে সামলে-বাড়ি সামলে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ। বিভার কথায়, ‘এক দিন বাবাও বলে দিলেন, আরও চার মেয়ে-তিন ছেলে আছে। তোমাকে কতদিন টানব? আমি গ্যারাজ ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলাম।’ স্বামীর পেনশন হিসেবে মাসিক ৬০০ টাকা ছিল সম্বল। সে টাকায় তো সংসার চলে না! তাই স্কুলে পড়ানোর কাজ নিয়েছিলেন। রাতের কলেজেও ভর্তি হন। মেয়েকে নিয়েই ক্লাসে যেতেন। এ ভাবেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বি–এড পাশ।
বিভা যে স্কুলে পড়াতেন, সেখানকার প্রিন্সিপাল ছিলেন আর্মি অফিসারের স্ত্রী। তাঁরই উৎসাহে সেনা অফিসারের পরীক্ষায় বসে পাশ করে যান। ধীরে ধীরে ‘মেজর’ হয়ে ওঠেন। বিভার কথায়, ‘মনে হতো সঞ্জয় সবসময় পাশে আছে।’ মেয়েকে নিয়েই ঘুরতে হয়েছে আসমুদ্র হিমাচল। ১৪ বছরের শর্ট সার্ভিস। পেনশন নেই। তাই আবার শুরু হয় যুদ্ধ। তবে ‘এক্স সার্ভিসম্যান হেল্থ স্কিম’-এ চাকরি পান। দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। মেয়ে দিব্যা পুদুচেরিতে ডাক্তারি পড়ার সময়ে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন। বিভা চাকরি ছেড়ে মেয়ের কাছে চলে যান। তার কথা ভেবেই তো আর বিয়ে করেননি কখনও। মেয়েকে সুস্থ করে একটি স্কুলের প্রিন্সিপালের চাকরি নেন। দিব্যা এমবিবিএস পাশ করে বিয়ে করেন। কিন্তু, সেখানেও সমস্যা! বিভা আবার চাকরি ছেড়ে দিল্লিতে বিদ্যার কাছে চলে যান। এখনও চাকরি খুঁজছেন ৫৩ বছরের রিটায়ার্ড মেজর বিভা সিং।
নারী দিবসে শুক্রবার বিভাকে সম্মান জানাল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইএমআরআই গ্রিন হেল্থ সার্ভিসেস। সংস্থার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (পিপিপি) গৌরব গুহ বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ কর্মীই মহিলা। আর আমাদের কাজ প্রসূতিদের বিনামূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা দেওয়া। মহিলা দিবসে সম্মান জানানোর জন্য বিভা ম্যাডামের থেকে যোগ্য আর কে হতে পারে!’