সুশান্ত বণিক, আসানসোল
বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ওঁরা কোরাসে সুর তুলে গাইছেন, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে’। উল্টোদিক থেকে হাতের তালে সমানে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন ৮৫ বছরের উদ্যমী এক মহিলা। কখনও তাঁকে বৃদ্ধা বলা যায় না কারণ, এই বয়সেও তাঁর নিরলস পরিশ্রম যে কোনও মানুষকে বিস্মিত করবে। ওই মহিলার লক্ষ্য একটাই, মানসিক ভাবে সক্ষমদের মধ্যে সুঠাম আত্মবিশ্বাসের ভিত গড়ে দেওয়া। আপাতদৃষ্টিতে সমাজে তাঁরা অবহেলিত, তবে সেটা তাঁদের লজ্জা নয়।
তিনি, পশ্চিম বর্ধমানের রূপনারায়ণপুরের বাসিন্দা মৈত্রেয়ী মজুমদার। চিত্তরঞ্জনের রেল কারখানার একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রাক্তন অধ্যক্ষা। প্রায় ৩৮ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে অলস্যে সময় না কাটিয়ে ২০১৩ সালে এই কাজে নেমে পড়েন তিনি। বলেন, ‘ছাত্র গড়ার কাজ থেকে অবসর নিয়ে ভাবছিলাম, কী ভাবে সমাজের কাজে নিজেকে যুক্ত করব। এক নিকট আত্মীয়ের পরামর্শে এই কাজে নেমে পড়লাম।’
মানসিক ভাবে সক্ষমদের নিয়ে কেন ভাবলেন? জবাবে মৈত্রেয়ী বলেন, ‘মানসিক সমস্যায় পীড়িতদের নিয়ে অভিভাবকেরা বিব্রত থাকেন, সমাজবদ্ধ মানুষও ওঁদের প্রতি খুব একটা সহমর্মী হন না। কিন্তু ভালো ভাবে দেখলে বোঝা যায়, ওঁদের মধ্যেও সূক্ষ্ম একটা অনুভূতি ও চেতনা থাকে। ওঁদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে সেটাকে উস্কে দিতে পারলেই ওঁরা নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন।’
২০১৩ সালে এলাকারই তিন জন বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষকে বাড়িতে এনে বন্ধুর মতো মিশতে থাকেন মৈত্রেয়ী। সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন নয় জনে পৌঁছেছে। ওঁদের কথায় অসংলগ্নতা রয়েছে। নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন না। সবই ভুলে যান। তাঁদেরই বাড়িতে এনে গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্রাক্তন ওই শিক্ষিকা। একইসঙ্গে শেখাচ্ছেন হাতের কাজও। তৈরি করা হচ্ছে কাগজের ফুল, গ্রিটিংস কার্ড, ঘর সাজানোর সামগ্রী। এলাকায় সে সব বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ ওঁদেরই মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন মৈত্রেয়ী। তিনি জানান, ওঁদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে সামাজিক ও আর্থিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তবে কাজটা শুরুতে মোটেই সহজ ছিল না। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে বিষয়টি পরিষ্কার হয় মৈত্রেয়ীর কাছে। তিনি জানান, অভিভাবকেরা দু’টি কারণে তাঁদের সন্তানদের প্রকাশ্যে আনতে চান না। প্রথমত, সঙ্কোচ বোধ, দ্বিতীয়ত, যে হেতু সন্তানরা স্বাভাবিক নন, তাঁদের পিছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে চান না কেউ। তাই প্রথমে অভিভাবকদের সচেতন করার কাজে নামেন মৈত্রেয়ী। রবীন্দ্রনাথের গান উদ্ধৃত করে বলেন, ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজেরে অপমান। ফলে সন্তানদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের বুকে মেলে ধরলে তাঁরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। অভিভাবকদের মধ্যে সঙ্কোচ বোধও কাটবে।’
এর পর আর থেমে থাকতে হয়নি মৈত্রেয়ীকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পথ চলা শুরু করেন। প্রায় ১১ বছরের লড়াইয়ে অর্ণব রায়, নিশাত পারভিন, স্বর্ণাভ সাহা–সহ আরও অনেককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। এখন তাঁরা কেউ গান, কেউ আবৃত্তি কেউ নাটক কেউ বা হাতের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। এই কাজে মৈত্রেয়ী পাশে পেয়েছেন নিজের কিছু ছাত্রীকে। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে এখনও সমানতালে সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ৮৫ বছরের বীরাঙ্গনা মৈত্রেয়ী মজুমদার। স্বগতোক্তি করে ওঠেন— মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।