কলেজ থেকেই বন্ধুর চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিলেন প্রত্যুষ ও প্রাজ্ঞ (নাম পরিবর্তিত)। একসময়ে দু’জনে সংসার পাতার কথা ভাবেন। তার পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে প্রাজ্ঞ হয়ে যান প্রজ্ঞা। বিয়েও সারেন দু’জনে। কিন্তু মনে ইচ্ছা থাকলেও ওই সমকামী দম্পতি ‘বায়োলজিক্যাল’ সন্তান থেকে বঞ্চিত ছিলেন শারীরবৃত্তীয় কারণেই। কারণ, গর্ভাশয় না থাকায় রূপান্তরকামী প্রজ্ঞার শরীর যে ডিম্বাণু উৎপাদনে অক্ষম!
বয়সের কারণে ডিম্বাণু তৈরিতে অক্ষম ছিল আরতি (নাম পরিবর্তিত) বিশ্বাসের শরীরও। তাঁর স্বামীর অবশ্য কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না। আবার স্ত্রী সুস্থ-সবল থাকলেও ক্যান্সারজয়ী সায়ন্তন (নাম পরিবর্তিত) রায়ের শরীরে শুক্রাণুর উৎপাদন থমকে গিয়েছিল কেমোথেরাপির কারণে।
প্রত্যুষ-প্রজ্ঞা হোক কিংবা বিশ্বাস ও রায় দম্পতি — কারও পক্ষেই টেস্টটিউব বেবির স্বপ্ন দেখাও ছিল অলীক কল্পনা। কারণ, ভ্রূণের জন্মের জন্য শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক বা ফার্টিলাইজ়েশন জরুরি। টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে সেই নিষেকই ঘটানো হয় শরীরের বাইরে, ল্যাবের মধ্যে। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে পারে ‘বায়োলজিক্যাল’ সন্তানকামী ওঁদের। কারণ, সেই গবেষণা বলছে, এমন নিষেকও সম্ভব, যেখানে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর দরকারই পড়বে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রয়োজনে চুল, ত্বক কিংবা রক্ত থেকে সংগৃহীত স্টেম সেলকে এডিট করে ল্যাবের মধ্যে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করে নেওয়ার রাস্তা দেখাচ্ছে কয়েকটি গবেষণা। এবং সেই ‘তৈরি করে নেওয়া’ ডিম্বাণু-শুক্রাণুর নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণের, অর্থাৎ পরবর্তীকালে সন্তানের জন্ম দেওয়াও সম্ভব।
অভিনব এই পদ্ধতির পোশাকি নাম ইন-ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস (আইভিজি)। গ্যামেট মানে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর মতো প্রজনন কোষ। পেরুতে সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া এক নবজাতকের জন্মবৃত্তান্ত তাই এখন বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় চর্চার কেন্দ্রে। সেই চর্চায় ব্যতিক্রম নয় কলকাতাও। একই পদ্ধতিতে ভ্রূণ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরাও। পিছিয়ে নেই পশ্চিম দুনিয়ার কয়েকটি দেশও।
প্রবীণ বন্ধ্যত্বরোগ বিশেষজ্ঞ সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের কথায়, ‘বিষয়টা এখনও গবেষণার স্তরে আছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি। অর্থাৎ, সম্ভাবনার ব্যাপারটা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।’ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, গত ডিসেম্বরে পেরুর রাজধানী লিমাতে গ্যামেটো নামে একটি সংস্থা দাবি করে, তাদের গবেষণার কল্যাণে আইভিজি পদ্ধতিতে একটি টেস্টটিউব বেবি বা ‘ফার্টিলো বেবি’ জন্ম নিয়েছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অবশ্য কোনও শিশু জন্মায়নি এখনও। তবে সেখানকার গবেষকরাও সফল আইভিজি-র মাধ্যমে গ্যামেট তৈরি ও শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেকের দাবি করছেন।
এই আইভিজি-কেই বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার ভবিষ্যত বলে আখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ। এবং সকলেই অপেক্ষা করছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলা এই সংক্রান্ত গবেষণার সাফল্যের পরে যেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও সফল হয়। আর সেই চূড়ান্ত সাফল্যের পরে যে আইভিজি পদ্ধতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না, তা হলফ করে বলছেন রোহিত ঘুটঘুটিয়া কিংবা সুজয় দাশগুপ্তের মতো বন্ধ্যত্বরোগ বিশেষজ্ঞরা। কারণ, বয়স, মেনোপজ়, রোগভোগ কিংবা কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার জেরে যে সব পুরুষের শুক্রাণু কিংবা মহিলার ডিম্বাণু উৎপাদন ঠিকমতো হয় না, আইভিজি পদ্ধতির সাহায্যে তাঁরাও টেস্টটিউব বেবির স্বপ্ন দেখতে পারবেন। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, সমকামী দম্পতিরা এখন বায়োলজিক্যাল বেবির ‘বাবা-মা’ হতে না-পারলেও আইভিজি পদ্ধতিতে সেটাও সম্ভব হবে। কারণ, এর জন্য সরাসরি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর দরকারই পড়ে না। দরকার শুধু পুরুষ বা মহিলা, যে কারও শরীরের যে কোনও সোমাটিক কোষ, যার স্টেম সেল দিয়ে তৈরি করে নেওয়া যাবে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শরীরে মূলত দু’ ধরনের কোষ হয়। একটি হলো শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর মতো রিপ্রোডাকটিভ সেল আর অন্যটি হলো শরীরের বাকি যে কোনও কোষ বা সোমাটিক সেল। প্রজনন ও নিষেকের জন্য জরুরি রিপ্রোডাকটিভ সেল। কিন্তু আইভিজি-র ক্ষেত্রে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এমন এক পদ্ধতির যাতে সোমাটিক কোষের স্টেম সেলকেই এডিট করে প্রজনন কোষ বানিয়ে নেওয়া সম্ভব। বস্তুত, ল্যাবের মধ্যে যে কোনও স্টেম সেল বা অঙ্কুর কোষকে প্রজনন কোষে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নির্মাণের উপযোগী ‘প্লুরি-পোটেন্ট গ্যামেট’ তৈরি করাই এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।
সেই গবেষণায় প্রাথমিক সাফল্যের বেশ কিছু ইঙ্গিত মেলার পরেই সারা দুনিয়ায় জল্পনা তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু এ নিয়ে গবেষণার সম্ভাবনা ভারত-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই সঙ্কুচিত বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বন্ধ্যত্বরোগ বিশেষজ্ঞ রোহিত ও সুজয় জানাচ্ছেন, সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি নিয়ে ভারত-সহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই যে আইন আছে, তাতে এমন ভাবে স্টেম সেলকে প্রজনন কোষে রূপান্তর করে টেস্টটিউব বেবি উৎপাদনের তেমন কোনও সংস্থান নেই। যে সব দেশে এই সংক্রান্ত আইনটাই নেই অথবা আইন থাকলেও তাতে এমন গবেষণার সুযোগ রয়েছে, সে সব দেশেই গবেষণাগুলো হচ্ছে।