• ‘মস্তি কি পাঠশালা’, পাঁশকুড়ার পার্থ মাস্টারের স্কুলে মহানন্দে চলছে প্রথম পাঠ
    এই সময় | ০৯ মার্চ ২০২৫
  • দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া

    পাঠশালা বসে শুক্রবারে/ পাঁশকুড়া স্টেশনে গাছের তলে। নাহ্, এমন কোনও স্লোগান নেই। তবে থাকলেও দিব্যি মানিয়ে যেত। সপ্তাহান্তে একটি দিন। আর সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকে ওরা। ওরা মানে, বস্তির একদল লোধা শিশু। হইহই করে চলে লেখাপড়া। সঙ্গে থাকে কেক, চকোলেট, বিস্কুট এবং আরও কত কী! তাই ‘ফ্রাইডে’ মানেই ওদের কাছে ‘ফান-ডে’। পূর্ব মেদিনীপুরে ট্যাবের টাকা নিয়েও বহু পরীক্ষার্থী এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে বসেনি।

    ‘শিক্ষায় এগিয়ে থাকা’ জেলায় স্কুলছুটের সংখ্যা দেখে উদ্বিগ্ন শিক্ষা আধিকারিকরা। জেলার বহু প্রান্তে বস্তিবাসী, পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের শিশুরা স্কুলমুখো হয় না। এমন আবহে ছকভাঙা পথে হেঁটে দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন পাঁশকুড়ার পার্থপ্রতিম পতি। বস্তির লোধা শিশুদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বছর তিনেক আগে কাজ শুরু করেন পার্থ।

    প্রতি শুক্রবার পাঁশকুড়া স্টেশন লাগোয়া গাছের তলায় বসে পার্থ মাস্টারের ‘মস্তি কি পাঠশালা’।৩০ জন লোধা শিশুর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন পার্থ। পড়াশোনার পাশাপাশি ওই পাঠশালায় দেওয়া হয় নতুন পোশাক, খাবারদাবারও। আর বকাঝকা? নৈব নৈব চ। ফলে, শিশুরাও পড়ছে মহানন্দে।

    সমগ্র শিক্ষা মিশনের মূল মন্ত্র— আনন্দপাঠ। শিক্ষাঙ্গনে আনন্দ পরিসরে শিশুরা খেলাচ্ছলে শিখবে লেখাপড়া। এটাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল নীতি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বাস্তবে সেটা হচ্ছে কি? আর যদি হয়েও থাকে, তা হলে স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছে কেন?

    পাঁশকুড়ার নস্করদিঘির বছর ছত্রিশের  পার্থ ইংরেজিতে অনার্স। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছাত্রজীবন থেকে টিউশন দেন পার্থ। নেশা সমাজসেবা। ২০০৮ সালে কলেজে পড়ার সময়ে ‘আমরা ছাত্রদল’ নামে তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন। ২০০৯ সালে হলদিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স পাশ করেন। চাকরির চেষ্টা করেও জোটেনি। তারপরে টিউশন আর সমাজসেবা নিয়েই এগিয়ে চলেছেন পার্থ। তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে অসহায়, দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ান।

    পাঁশকুড়া স্টেশন লাগোয়া ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় প্লাস্টিক কুড়িয়ে দিন গুজরান করেন বহু মানুষ। রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে তাঁরা থাকেন। এলাকাটি লোধাপাড়া নামে পরিচিত। সকাল হলেই বড়রা বেরিয়ে পড়েন প্লাস্টিক কুড়োতে। ছোটদের দিন কাটত বনে-বাদাড়ে ঘুরে। কেউ কোনওদিন স্কুলমুখো হয়নি।বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে পার্থকে।

    লোধাপাড়ার  শিশুদের সাক্ষর করে তোলার লক্ষ্যে পাঠশালা খোলেন তিনি। প্রতি শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে পাঠশালা। প্রথমে শিশুরা আসতে চাইত না। পার্থ ওদের জন্য নিজের টাকায় বই, খাতা, কলম ও নতুন পোশাক নিয়ে হাজির হলেন। সঙ্গে চকোলেট, কেক, বিস্কুট আরও কত কী! নতুন বই-খাতা, পোশাক আর খাবারের টানে শিশুরা পার্থের পাঠশালায় আসতে শুরু করে।পার্থও শেখাতে শুরু করেন অ আ ক খ, এ বি সি ডি, নামতা। এখন আর ওদের ডাকতে হয় না। শুক্রবার সকাল হলেই পড়ুয়ারা গাছতলায় ত্রিপল বিছিয়ে অপেক্ষা করে ‘পার্থ স্যরের’ জন্য। পার্থ হাসছেন, ‘আগে ওরা ‘মাস্টার’ বলত। এখন ‘স্যর’ বলেই ডাকে। প্রত্যেকেই নিজের নাম লিখতে পারে। বানান করে করে সংবাদপত্রও পড়ে। ওদের অনেকে স্কুলেও ভর্তি হয়েছে। এটা আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি।’

    পার্থর উদ্যোগে খুশি লোধাপাড়াও। মন্দিরা সিং বলে, ‘আগে স্কুলে যেতাম না। পরে পার্থ স্যরের পাঠশালায় যেতে শুরু করি। এ বছর স্কুলেও ভর্তি হয়েছি।’

    বছর দশেকের পূর্ণিমা ভক্তার কথায়, ‘শুক্রবার সকাল হলেই স্যর বইখাতা, বিস্কুট, চকোলেট নিয়ে চলে আসেন। আমরা খুব আনন্দে লেখাপড়া করি।’

    সমীর প্রামাণিক নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘সকাল হলেই আমরা প্লাস্টিক কুড়োতে যাই। বিকেলে বাড়ি ফিরি। পার্থ মাস্টার আমাদের ছেলেপুলেদের পড়ান। আমরা খুব খুশি।’

    মাকে নিয়েই পার্থের সংসার। টিউশনের টাকায় কোনও রকমে সংসার চলে যায়। আয়ের কিছুটা অংশ আর বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় পার্থ এগিয়ে চলেছেন নিজের লক্ষ্যে। নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন মহাভারতের অর্জুনও। তাঁর আরও একটা নাম যেন কী! ‘মস্তি কি পাঠশালা।’

  • Link to this news (এই সময়)