এই সময়, কাটোয়া: মন্দির প্রাচীন। তার রীতিনীতিও প্রাচীন। ৩৫০ বছরের শিবের পুজোয় গোটা গ্রাম সামিল হলেও, মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই মুচি সম্প্রদায়ের। ‘নিচু জাতের’ তকমা দিয়ে মন্দিরে উঠতেই দেওয়া হয় না গ্রামের প্রায় ১০০টি পরিবারের সদস্যদের।
দেশের কয়েকটি রাজ্য থেকে দলিত–হরিজনদের ‘অস্পৃশ্য’ করে রাখার মতো কিছু ঘটনা সামনে আসে, তবে এই ঘটনা রাজ্য রাজধানী কলকাতা থেকে মাত্র ১৫৫–১৬০ কিমি দূরের।
এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে কাটোয়া এক ব্লকের গিধগ্রামে। দীর্ঘ দিন ধরে বঞ্চনার শিকার ওই এলাকার দাসপাড়ার মানুষেরা এ বার সমানাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। মন্দিরে সবার মতো পুজো দিতে চান তাঁদের পরিবারের মেয়ে-বউরাও।
অন্য দিকে, এত দিন ধরে যাঁরা এই নিয়ম বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, গ্রামের সেই তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকজন চাইছেন না, প্রথা ভেঙে মন্দিরে আসুন দাসেরা। এ নিয়ে ছাইচাপা আগুন জ্বলছে গ্রামে। মন্দিরে যাতে সবাই পুজো দিতে পারেন তার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা।
গিধগ্রামে গিধেশ্বর শিবের নিত্যসেবা হয় সারা বছর। শিবরাত্রি, গাজন উৎসবে ব্যাপক ধুমধাম হয় এখানে। তবে এই মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই মুচি সম্প্রদায়ের লোকেদের। শিবরাত্রির দিন দুয়েক আগে গিধগ্রামের দাসপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা প্রশাসনের কাছে অভিযোগে জানান, স্রেফ মুচি হওয়ার কারণে মন্দিরে পুজো দিতে দাসপাড়ার শতাধিক পরিবারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে তাঁদের গালিগালাজ করা হচ্ছে। এর পরে কাটোয়ার মহকুমাশাসকের উদ্যোগে গত ২৮ ফ্রেবুয়ারি একটি বৈঠকও হয়। বৈঠকে হাজির ছিলেন কাটোয়া ও মঙ্গলকোটের দুই তৃণমূল বিধায়ক, কাটোয়া মহকুমা পুলিশ আধিকারিক, কাটোয়া এক ব্লকের বিডিও, গিধেশ্বর মন্দির কমিটির কর্মকর্তা এবং দাসপাড়ার প্রতিনিধিরা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রামদেবতার পুজোর অধিকার গ্রামবাসী সমান ভাবেই পাবেন। দু’পক্ষ তাতে সন্মতিও দেয়।
কিন্তু গত শুক্রবার দাসপাড়ার কয়েকজন মন্দিরে পুজো দিতে গেলে ফের তাঁদের পথ আটকানো হয়। দাসপাড়ার বাসিন্দা এককড়ি দাসের অভিযোগ, ‘আমরা শিবমন্দিরে পুজো দিতে গেলে তালা খোলা হয়নি। পুজোও দিতে পারিনি।’ আর এক গ্রামবাসী মদন দাস বলেন, ‘বৈঠকের পরেও অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি। আমরা পুজো দিতে গেলে মন্দিরে উঠতে দেওয়া হয়নি।’ সে দিন দু’পক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। তবে পুজো না দিয়েই ফিরে যেতে হয় দাসপাড়ার বাসিন্দাদের। এর পর দফায় দফায় বৈঠক হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। রবিবারও পুজোর অধিকার পায়নি দাসেরা।
এ দিন অশোক দাস বলেন, ‘শুক্রবারের ঘটনার পরে প্রশাসন একাধিকবার বৈঠক করেছে। তবে এখনও আমরা পুজোর অধিকার পাইনি। দীর্ঘ দিন ধরে যে বঞ্চনা হচ্ছে, সেটা আর চলতে দেবো না। আমাদের মন্দিরের সিঁড়িতেও উঠতে দেওয়া হয় না। আমাদের পুজোর অধিকার দিতে হবে। প্রশাসন ব্যবস্থা করবে বলে আমাদের ভরসা আছে।’ অন্য দিকে, মন্দিরের সেবায়েত মাধব ঘোষ বলেন, ‘এত দিনের নিয়ম এক দিনে বদলে ফেলা যায় না। আমরা চাই, মন্দির যে নিয়মে চলে এসেছে সেই নিয়মেই চলুক। ওঁরা পুজো দিতে চাইলে সেই ব্যবস্থা আমরা করব। তবে পুজো হবে মন্দিরের নিয়ম মেনে। সব পক্ষ থেকে সেই রেজ়োলিউশন করা হবে।’ মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে এ নিয়ে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পূর্বসূরিদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী গিধেশ্বর শিবের পুজোয় মালাকার সম্প্রদায় মন্দিরের ভিতর পরিষ্কার করেন। ঘোষ সম্প্রদায় ভোগের জন্য দুধ–ছানা ইত্যাদি দেন। কুম্ভকার মাটির হাঁড়ি সরবরাহ করেন। হাজরা সম্প্রদায় মশাল জালানোর দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া কোটাল, বাইন ইত্যাদি সম্প্রদায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ ছাড়া গর্ভগৃহে কারও প্রবেশাধিকার নেই। এটাই তিন শতাব্দী ধরে চলে আসছে।
এ প্রসঙ্গে কাটোয়ার এক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, গ্রামবাসীর সঙ্গে আলোচনা চলছে। চেষ্টা করা হচ্ছে সমাধানসূত্র বের করার। সমস্যা মিটে যাবে বলে আশাবাদী মঙ্গলকোটের তৃণমূল বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘মন্দিরে সবাই পুজো দেবে এটাই সিন্ধান্ত। সবার সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। সমস্যা মিটে যাবে।’