দোল উৎসবে ব্রিটিশদের শুরু করা নিয়ম আজও পালন করেন মুর্শিদাবাদবাসী, কী সেই নিয়ম?...
আজকাল | ১০ মার্চ ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই রঙের উৎসব হোলি বা দোলযাত্রা। কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে আজও মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে দু'দিনের দোল উৎসব পালন করা হয়। একসময় মুর্শিদাবাদের রাজা-নবাব এবং জমিদারদের ঐশ্বর্য এবং বৈভব দেখানোর উৎসব ছিল, দোলযাত্রা।
মুর্শিদাবাদ জেলার বহু ঐতিহাসিক বলেন, একদা মুর্শিদাবাদের দোলযাত্রা ছিল 'সামন্ত সংস্কৃতি'র বহিঃপ্রকাশ। বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদে হোলি বা দোল উৎসবের জাঁকজমক আরও বৃদ্ধি পায় ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' চালু করার পর।
তাঁরা বলেন, এই বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর বহু রাজা-মহারাজা-জমিদার নিজেদের 'কাছারি বাড়ি' বহরমপুর এবং আশেপাশের এলাকায় তৈরি করেছিলেন যাতে 'সূর্যাস্ত আইন' মেনে সময়মতো তাঁরা ব্রিটিশ সরকারকে বাৎসরিক খাজনা দিতে পারেন।
মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, জেলার প্রখ্যাত জমিদার বৈকুন্ঠ নাথ সেন, হরি সেন এবং কাশিমবাজার-কান্দি-জিয়াগঞ্জের মহারাজারা বৈষ্ণব ধর্মের অনুগামী ছিলেন। এই জমিদার এবং মহারাজারা দুর্গাপুজো এবং দোল উৎসবের সময় নিজেদের বৈভব এবং প্রাচুর্যের প্রদর্শন করতেন।
দোল উৎসবের আগের দিন মুর্শিদাবাদের রাজা এবং জমিদাররা 'চাঁচল' উৎসব ('নেড়া পোড়া' নামে বহুল প্রচলিত) পালন করতেন। সেই দিন রাজা এবং জমিদাররা বাজি ফাটিয়ে নিজেদের গৃহ দেবতাকে ভাগীরথী নদীতে স্নান করানোর জন্য নিয়ে যেতেন।
দোল উৎসবের দিন রাজা এবং জমিদাররা তাঁদের নিকট আত্মীয়-বন্ধু এবং লাঠিয়ালদের সঙ্গে রং এবং আবির খেলতেন। কিন্তু অনেক সময়ই রাজা-মহারাজ এবং জমিদারদের আনন্দের এই উৎসব রক্তাক্ত হয়ে উঠত যখন বিভিন্ন রাজা-জমিদারদের লাঠিয়ালরা রং খেলতে খেলতে একে অপরের সম্মুখীন হয়ে পড়তেন। এই সমস্ত সামন্ত প্রভুদের প্রভাব এতই বেশি ছিল যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত 'কালেক্টর'-এরও অনেক সময়ই এই লড়াই বন্ধের জন্য বেশি কিছু করার ক্ষমতা ছিল না।
ঐতিহাসিক দেবেন্দ্র দাস বলেন, 'দোল উৎসবের সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আটকানোর জন্য বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ প্রিভি কাউন্সিল একটি 'অর্ডার' পাস করে। সেই আদেশনামায় বলা হয়, খাগড়া, সৈদাবাদ এবং গোরাবাজার এলাকায় বসবাসকারী রাজা-জমিদারেরা দু'টি পৃথক দিনে দোল খেলবেন।'
ব্রিটিশ আমলে শুরু হওয়া সেই রীতি আজও প্রচলিত রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। যদিও ঐতিহাসিকেরা বলেন, জমিদারি ব্যবস্থা অবলুপ্তির পর মুর্শিদাবাদ জেলায় দোল উৎসবের জাঁকজমক অনেকটাই কমে গিয়েছে। এক সময় দোল উৎসবের দিন জেলার রাজা-মহারাজা এবং জমিদাররা তাঁদের পরিচিত এবং বিশেষ বন্ধুদেরকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে প্রচুর খাওয়াতেন এবং বিশেষ মিষ্টি বিতরণ করতেন।
রমেশ সাহা নামে বহরমপুরের এক কলেজ পড়ুয়া বলেন, 'বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলায় দোল বা হোলি উৎসবের জাঁকজমক অনেকটাই কমে গিয়েছে। তার পরিবর্তে এখন আমরা 'বসন্ত উৎসব' পালন করতে দেখি। প্রচুর সংগঠন এখন দোলের আগে থেকেই 'বসন্ত উৎসব' পালন করছে। সেখানে মূলত রং এর পরিবর্তে আবির খেলা হয়।'
তবে পুরনো ঐতিহ্য যে সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছে তেমনটাও নয়। আজও বহরমপুর সহ বেশ কিছু এলাকায় প্রচুর মানুষ দোল উৎসবের দু'দিন প্রাণের আনন্দে রং মাখেন। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।