শীতল চক্রবর্তী, বালুরঘাট
এলাকার নিরাপত্তা বা অপরাধ দমনে সর্বদা অন ডিউটি পুলিশ। কিন্তু মাঝে মধ্যেই খাকি উর্দির সেই চেনা কাঠখোট্টা থেকে বেরিয়ে আসে একটি নরম সত্ত্বা। তাই লাঠি–বন্দুকের মধ্যেই তাঁরা সময় বার করে হাতে তুলে নেন বই, খাতা–কলম। রবিবারের সকালটা স্থানীয় দুঃস্থ বাচ্চাদের পড়ানোর মধ্যে দিয়েই কাটান।
আর এলাকার যে সকল খুদেরা পুলিশের নাম শুনলেই ভয় পেত, আজ তারাও রবিবার হলেই পুলিশ কাকুদের ক্লাস করতে উৎসুক হয়ে ওঠে। এমনই উদ্যোগ নিয়েছে বালুরঘাট জিআরপি থানার পুলিশকর্মীরা। সমাজের ভবিষ্যৎ গড়তে, বঞ্চিত বা সুযোগ না পাওয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে মাঠে নেমেছেন তাঁরা।
২০২৩–এ সেখানকার ওসি রতন সরকারের উদ্যোগে প্রথম শুরু হয়েছিল এই সমাজসেবামূলক কর্মসূচি। প্রতি রবিবার থানার গাছতলায় বসতো সেই স্কুল। যদিও স্কুলের জন্য আলাদা করে কোনও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। উর্দিধারী কয়েকজনই খুদে পড়ুয়াদের শিক্ষক। স্টেশন সংলগ্ন গ্রামের প্রায় ৩০জন গরিব ও দুস্থ শিশুকে নিয়ে প্রথম শুরু হয় স্কুল।
পরিবারের আর্থিক অনটনে যারা টিউশন পড়তে যেতে পারে না, কিংবা পর্যাপ্ত বই-খাতার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে বাকিদের থেকে—তাদের ভবিষ্যতের দিশা দেখাতেই এগিয়ে এসেছেন এই পুলিশ–স্যরেরা। ওসির কথায়, ‘পুলিশ মানেই শুধু অপরাধীদের ধরার দায়িত্ব? তা তো নয়, সমাজ গড়ার দায়িত্বও রয়েছে আমাদের উপর। এই সমস্ত শিশুরা বড় হয়ে যদি সুশিক্ষিত মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠে, সেটাই হবে আমাদের বড় প্রাপ্তি’।
সেখানে পাঠ্যবইয়ের পড়া ছাড়াও দেওয়া হয় জীবন গড়ার পাঠ। বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজির পাশাপাশি পড়ানো হয় সাধারণ জ্ঞান। শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে শেখানো হয় দাবার মতো সব ইন্ডোর গেম। সেই সঙ্গে লেখাপড়ায় আগ্রহ জিইয়ে রাখতে আয়োজন করা হয় ক্যুইজ়েরও।
পড়াশোনার ফাঁকে খুদেদের জন্য টিফিনের ব্যবস্থাও করেন তাঁরা। আর যে সকল শিশুর বই নেই, থানার তরফে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বই। স্থানীয়রাও প্রশংসা করেছেন এই উদ্যোগের। এক অভিভাবক বললেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা এতদিন পুলিশের কথা শুনলেই ভয় পেত। এখন ওরাই বলে—রবিবারে স্কুলে যাব। এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’
শুধু আইন রক্ষাই নয়, তার বাইরেও আগামী প্রজন্মকে ভবিষ্যতের দিশা দেখাচ্ছেন রতন সরকার এবং তার টিম, তা মানছে প্রশাসনিক মহলও। একদিন এই ছোট্ট পাঠশালা থেকেই জন্ম নেবে ভবিষ্যতের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক–প্রশাসক হয়তো দাবাড়ু বা শিল্পী! এমনটাই আশা করছে তারা।
পুলিশ মানেই শুধু অপরাধীদের ধরার দায়িত্ব?
সমাজ গড়ার দায়িত্বও রয়েছে আমাদের উপর। শিশুরা বড় হয়ে যদি মানুষ হয়ে ওঠে, সেটাই হবে বড় প্রাপ্তি। বললেন রতন সরকার, বালুরঘাটের ওসি।