এই সময়: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা কাটাতে কর্তৃপক্ষের ডাকা বৈঠকে পড়ুয়ারা যে হাজির থাকবেন, সে কথা তাঁরা আগেই জানিয়েছিলেন। সেই মতো সোমবার বিকেল ৩টে থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সবক’টি ছাত্র সংগঠনের বৈঠক শুরু হলেও সাড়ে ছ’ঘণ্টা পরেও তা শেষ হয়নি।
এই বৈঠক শুরুর আগেই নতুন করে বিতর্ক শুরু হলো ক্যাম্পাসে সাদা পোশাকের পুলিশের উপস্থিতি ঘিরে। এ দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়েই পড়ুয়াদের একাংশের বিক্ষোভের জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
তার আগেই কলকাতা পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে সাদা পোশাকে বিশাল পুলিশ বাহিনী ছিল ক্যাম্পাসের আর্টস ফ্যাকাল্টির আনাচেকানাচে। ওমপ্রকাশ ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে থেকেই পাঁচ নম্বর গেটের বাইরে সাদা পোশাক ও উর্দিধারী আরও পুলিশ মোতায়েন ছিল। প্রবীণ এই অধ্যাপক ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়ে গেটের বাইরে থাকা সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরাও অনেকে ভিতরে ঢুকে পড়েন। উর্দিধারীরা ছিলেন বাইরে।
এ দিনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, ক্যাম্পাসে পুলিশকে ডাকল কে? কারণ, ১ মার্চ যে দিন পড়ুয়াদের একাংশের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল যাদবপুর ক্যাম্পাস, সে দিন শুধুমাত্র শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর নিরাপত্তারক্ষীরা ছাড়া কোনও পুলিশকর্মী ক্যাম্পাসে ঢোকেননি। ব্রাত্য নিজে বলেছিলেন, তিনি নিরাপত্তার জন্য শিক্ষাঙ্গনে পুলিশ ডাকবেন না। অন্তর্বর্তী উপাচার্য ভাস্কর গুপ্ত সে দিন পরিস্থিতি বিবেচনা করে পুলিশ ডাকতে চাইলেও মন্ত্রী তাতে রাজি হননি। তা ছাড়া শিক্ষাঙ্গণে প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ না–ঢোকাটাই রীতি। তা হলে পুলিশ কেন এ দিন ক্যাম্পাসে? সহ উপাচার্য অমিতাভ দত্ত বলেন, ‘কে পুলিশ ডেকেছে, আমি জানি না।’
জয়েন্ট রেজিস্ট্রার সঞ্জয়গোপাল সরকারও এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি। আর ওমপ্রকাশ বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ শিক্ষক। আমার পুলিশ ডাকার কোনও ক্ষমতাই নেই।’ লালবাজার কি তবে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পুলিশ পাঠিয়েছিল? পুলিশকর্তারাও এই প্রশ্নে নিরুত্তর।
ওমপ্রকাশ রবিবার এক ভিডিয়ো বার্তায় জানিয়েছিলেন, তিনি সোমবার দুপুর ১২টায় ক্যাম্পাসে যাবেন। উপাচার্যকে তিনি ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আর্জি জানিয়েছেন। নতুন করে গোলমালের আশঙ্কাতেই কি তা হলে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল— তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে থাকা পুলিশকর্মীরা জানান, তাঁরা রিজ়ার্ভ ফোর্স থেকে এসেছেন উপর মহলের নির্দেশে। ঘণ্টা চারেক বাদে তাঁরা ক্যাম্পাস থেকে বাইরে বেরোতেই পড়ুয়াদের একাংশ স্লোগান তোলেন, ‘পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়/ তৃণমূলের ঝান্ডা ধরো’।
এর আগে বিভাগীয় প্রধান বিজয়কুমার দাসের সাহায্যে ক্যাম্পাসে নিজের ঘরে ঢোকেন ওমপ্রকাশ। তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ক্যাম্পাসের পাঁচ নম্বর গেটে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ডিএসও–এসএফআই সমর্থকরা। ওমপ্রকাশ কোনওরকমে হাতজোড় করে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। পড়ুয়াদের অভিযোগ, ঘটনার দিন দু’জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেন ওমপ্রকাশ। পড়ুয়াদের সঙ্গে অভব্য আচরণও করেছেন।
এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে ওমপ্রকাশ বলেন, ‘আমি ক্যাম্পাসে সবচেয়ে প্রবীণ অধ্যাপক। আমাকে ঘটনার দিন আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কেন পড়ুয়ারা একজন অধ্যাপককে মারধর করেছিলেন, আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তার জবাব ওঁদেরই দিতে হবে। যাদবপুরকে কালিমালিপ্ত করতে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’ ওমপ্রকাশ ঘরে ঢুকলেও তার দরজার সামনে মাটিতে কয়েকজন ছাত্রী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘আপনি কি আবার হ্যারাস করতে এসেছেন!’
ওমপ্রকাশের ক্যাম্পাসে ঢোকা নিয়ে গোলমাল হচ্ছে শুনে ঘটনাস্থলে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটার সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনও ব্যক্তিকে ঘেরাও, নিগ্রহ এবং আক্রমণের বিরোধী। উনি আটকে পড়েছেন শুনে আমরা এসেছি। আমরা ওঁর ঘরে ঢোকার সময়ে বলি, পুলিশ থাকলে আর শিক্ষকদের মধ্যে কী কথা হবে? তখন পুলিশ ওঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।’ বিকেলে ওমপ্রকাশ ক্যাম্পাস থেকে বেরনোর সময়ে তাঁর কাছে আবার আসেন পার্থপ্রতিম ও ওয়েবকুপার সহ–সভাপতি সেলিম বক্স মণ্ডল। এ দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি ভবনে ‘আজ়াদ কাশ্মীর’ স্লোগান লেখার প্রতিবাদে সরব হন ওমপ্রকাশ। তিনি বলেন, ‘এটা পাকিস্তানের দাবি। সম্পূর্ণ দেশবিরোধী। জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
এ দিকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রণবকুমার গায়েনের ডাকা প্রশাসনিক বৈঠকে রাত পর্যন্ত রয়েছেন সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্ত, জয়েন্ট ও ডেপুটি রেজিস্ট্রাররা, ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়-সহ বিভিন্ন শাখার ডিন ও বিভাগীয় প্রধানেরা। এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ প্রথমে প্রশাসনের আধিকারিকদের নিজেদের বৈঠক শুরু হয়। বিকেল তিনটে নাগাদ সেই বৈঠকে যোগ দেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আটটা নাগাদ কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা স্মারকলিপিতে দাবি করেন, অবিলম্বে কর্মসমিতির (ইসি) জরুরি বৈঠক ডাকতে হবে। পড়ুয়াদের পুলিশি হেনস্থা বন্ধ করতে হবে। ওমপ্রকাশের ক্যাম্পাসের আসা বন্ধ করতে হবে।