‘পজ়িটিভ’দের ‘ক্যাফে’ এ বার ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে রাজ্য রাজধানী ছাড়িয়ে কান্ট্রি ক্যাপিটাল-এ। সেই সঙ্গে ‘পজ়িটিভ’দের জন্য নতুন হাসপাতাল তৈরি হবে কলকাতা লাগোয়া সোনারপুরে। এইচআইভি-তে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে ‘আনন্দঘর’, তার ‘এক ঝাঁক ইচ্ছেডানা’ এ বার ক্যাফের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে চলেছে কলকাতার আরও অনেক জায়গায়।
শিশুদের অধিকার রক্ষার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন সমাজসেবী কল্লোল ঘোষ। তাঁর তত্ত্বাবধানেই চলে ‘আনন্দঘর’। HIV আক্রান্ত শিশুদের ঠিকানা সোনারপুরের লাঙলবেড়িয়ার ‘আনন্দঘর’ (মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুরাও থাকে সেখানে)। বিনা খরচে ১২০ জনেরও বেশি শিশুর দেখাশোনা করা হয় ‘আনন্দঘর’-এ।
কঠিন সময়ে যখন আপনজনরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এই শিশুদের থেকে, কয়েকজনকে যখন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল পরিবার, তখন তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে জন্ম হয়েছিল ‘আনন্দঘর’-এর। মাথায় ছাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হোম ওই শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল। ধীরে-ধীরে তৈরি হয়েছে নাচ, গান, আঁকা শেখারও ব্যবস্থা। লক্ষ্য একটাই, তাদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা। বাচ্চাদের হুল্লোড়, আবদার, বেঁচে থাকার লড়াই সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টাই ‘পজ়িটিভি’তে ভরপুর ‘আনন্দঘর’।
‘আনন্দঘর’-এর সোনারপুরের পরিধি ছাড়িয়ে বছর কয়েক আগে HIV পজ়িটিভদের নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ‘ক্যাফে পজ়িটিভ’-এর। এশিয়ায় প্রথম HIV পজ়িটিভদের নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া এই ‘ক্যাফে পজ়িটিভ’। প্রথমে লেক ভিউ রোড এবং পরে পাটুলিতে এই ক্যাফের দু'টি আউটলেট তৈরি হয়। যাঁরা ক্যাফে চালান, তারা প্রত্যেকেই HIV পজ়িটিভ। সমাজের একাংশ যখন এইডস রোগীদের ব্রাত্য করে রাখে, তখন ক্যাফের নামকরণের (‘ক্যাভে পজ়িটিভ’) মাধ্যমে সেই সোশ্যাল স্টিগমাকেই কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন কল্লোল ঘোষ। আগামী ১ এপ্রিল থেকে ইএম বাইপাসের কালিকাপুর ও আউটট্রাম ক্লাবে এই ক্যাফের আরও দু'টি আউটলেট চালু হতে চলেছে। পাশাপাশি কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে ‘পজিটিভ বার্তা’ ছড়িয়ে দিতে দিল্লির অক্ষয়ধাম মন্দির সংলগ্ন এলাকা এবং ঝিলমিলে ইন্দিরা গান্ধী ইএসআই হাসপাতালের বিপরীতেও আরও দু'টি ক্যাফে চালু হবে চলতি মাসেই।
এই উদ্যোগগুলির নেপথ্য নায়ক কল্লোল ঘোষ বলেন, ‘সোনারপুরের লাঙলবেড়িয়ায় ৬০ হাজার স্কোয়ারফুট জায়গায় নতুন হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে দু'টি ব্লক থাকবে। একটিতে চিকিৎসা করা হবে HIV পজ়িটিভ শিশুদের। অন্যটিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সমস্ত হোমের শিশুদের বিনামূল্যে সমস্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য থাকবে ১০টি বেড। যেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রক্ত দেওয়া হবে এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের।’
HIV নিয়ে সমাজের ‘পরিচিত’ ছুঁৎমার্গকে কখনওই তোয়াক্কা করেননি কল্লোল। তিনি জানান, এই শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য একাধিক পদক্ষেপ করা হয়। তাদের খাওয়া-দাওয়ার দিকে থাকে বিশেষ নজর। এ ছাড়াও তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজও শেখানো হয়। পাশাপাশি হাত বাড়ালেই মেলে একে অপরের সঙ্গও।
১৮ বছর পার হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী কোনও সরকারি হোমের আবাসিককে ‘আনন্দঘর’-এ রাখা সম্ভব নয়। হোম থেকে বের হওয়া তরুণ-তরুণীরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন, সে জন্য মুকুন্দপুর এবং লেক গার্ডেন্সে দু'টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু করা হয়েছে কল্লোলের তত্ত্বাবধানে। ছেলেদের জন্য মুকুন্দপুর এবং মেয়েদের জন্য লেক গার্ডেন্সে তৈরি করা এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের বিনামূল্যে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্সের জিনিসপত্র সারাই করা, ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁয় কাজ করার জন্যও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।