অর্ঘ্য ঘোষ
দূর থেকে দেখলে শুধু অবয়বখানাই এখন চোখে পড়ে। ঘন ঘাসের জঙ্গল, ইঁটের ফাঁক দিয়ে মাথা তোলা বট অশ্বথের অবাধ বাড়বৃদ্ধি দেখে মনে হতেই পারে এখানে আসলে ‘তেনাদের’ বাস। নিদেনপক্ষে ভূতের সিনেমার পারফেক্ট সেট। ভগ্নপ্রায় কুঠি ছিল এককালের জমজমাট ইমারত, পুরোনো বাংলার অন্যতম সর্ববৃহৎ শিল্প অট্টালিকা। হাজার হাজার মানুষের জীবিকা ধারণের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস তৈরি করেছিল এই কুঠি। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো স্মারক এখন হারাতে চলেছে কালের গর্ভে।
বীরভূমের এই ইমারতকে স্থানীয়রা কেউ বলেন নীলকুঠি। কারও মতে রেশমকুঠি। এলাকার মানুষজন অবশ্য ইংরেজ আমলের গুনুটিয়ার কুঠিকে নীলকুঠি বলতেই অভ্যস্ত। গবেষকদের মতে, ওই কুঠিতে রেশমের কারবার ছিল। আজও কুঠির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের নানা স্বারকচিহ্ন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে বসেছে কুঠির মূল্যবান সেইসব স্মারকচিহ্ন।
ময়ূরেশ্বরের আমড়া এবং লাভপুরের গুনুটিয়ার মাঝ বরাবর বয়ে গিয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী। কুঠিটি আমড়া গ্রাম লাগোয়া। একালের মানুষজনের কাছে পরিচিত গুনুটিয়ার কুঠি নামে। এর সঙ্গে জড়িয়ে বাংলার রেশম চাষের ইতিহাস। বিভিন্ন নথি ঘেঁটে জানা গিয়েছে , ১৭৮৩ সালে ব্রেগান্ট্রি নামে এক ইংরেজ বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যস্থতায় রাজনগরের রাজার কাছে থেকে রেশমচাষের জন্য কিছু জমি বন্দোবস্ত পান। সেই জমির উপরেই তিনি এই কুঠির প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্রেগান্ট্রি সাহেবের অকাল মৃত্যুতে এডওয়ার্ড এই কুঠির রক্ষক নিযুক্ত হন। ১৭৮৫ সালে ২০ হাজার টাকায় কুঠিটি কিনে নেন ফরাসি বণিক তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মাশিয়াল এজেন্ট ফ্রুসার্ড । তিনি ওই কুঠিতে রেশমের কারবার শুরু করেন। কিন্তু, ৬ মাসের মাথায় ময়ূরাক্ষীর ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় কুঠি। সেই ক্ষতিপূরণের জন্য তিনি বীরভূমের রাজনগরের তদানীন্তন রাজা মহম্মদ উলজামান খানের দ্বারস্থ হন। একর প্রতি বাৎসরিক ৩ টাকা ৪ আনার খাজনার চুক্তিতে ১২ বছরের মেয়াদে ওই এলাকায় ২৫০০ বিঘে জমি বন্দোবস্ত পান ফ্রুসার্ড । কিন্তু চুক্তি মতো খাজনা দিতে না পারায় রাজরোষে পড়েন তিনি। রাজা মহম্মদ উলজামান খান ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
১৮০৭ সালে ফ্রুসার্ডের মৃত্যু হয় । তাঁর মৃত্যুর পর ইংরেজ সরকার কুঠিটি অধিগ্রহণ করে জন চিপ কর্মাশিয়াল রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। চিপ সুরুলের কুটিরও রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁকে ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে নানা কথা শোনা যায়। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে , তাঁরা বাপ ঠাকুদার মুখে শুনেছেন চিপসাহেব যখন পালকি চেপে যেতেন তখন তাঁকে দেখার জন্য মিছিলের মতো লোক পিছু নিত। তাঁর ছায়া কোন বাচ্চার গায়ে লাগলে তাকে ভাগ্যবান মনে করে মায়েরা হাত জোড় করে কপালে ঠেকাতেন। কার্যকাল শেষে অন্যান্য ইংরেজ কর্মচারী নিজ দেশে ফিরে গেলেও চিপ এবং তাঁর স্ত্রী ওই কুঠিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মোহের টানেই তাঁদের কুঠির জমিতেই কবর দেওয়া হয় বলে অনুমান। স্থানীয়রা বলেন, ওই কুঠিতে দুটি সমাধি রয়েছে। সে দুটি তাঁদের বলেই অনুমান করা হয়।
বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরা এই কুঠির আনাচকানাচে। কিন্তু সেই ইতিহাসই এখন ধ্বংসের মুখে। সংরক্ষণের অভাবে ধংস হতে বসেছে চিপ এবং তার স্ত্রীর সমাধি, সুউচ্চ চিমনি, প্রাসাদ, গোলাকৃতি ড্রয়িং রুম, গুদামঘর সহ আরও নানা স্মারকচিহ্ন। গবেষকদের দাবি, ওইসব স্মারকচিহ্ন সংরক্ষণ করা হলে নদী তীরবর্তী গাছগাছালি ঘেরা পরিত্যক্ত কুঠিবাড়িটি একটি দারুণ দর্শনীয় স্থান হতে পারে। পুরাতত্ত্ব গবেষক সুনীল পাল বলেন,‘ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে ওই কুঠির গুরুত্ব অপরিসীম। অবিলম্বে সংরক্ষণ করা না হলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে প্রাচীন ইতিহাস।
তবে বর্তমানে অবশ্য কুঠিটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিনের দাবি মেনে কুঠি লাগায়ো ময়ূরাক্ষী নদীর উপরে একটি সেতু নির্মিত হয়েছে। লাভপুরের ভূমিপুত্র কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে তারাশঙ্কর সেতু। এই সেতুটির জন্যই দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তাই একটি পর্যটন ক্ষেত্র হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে এই কুঠি।