দিগন্ত মান্না ■ পূর্ব মেদিনীপুর
২০২১ বিধানসভার পরে গত লোকসভা ভোটেও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অভাবনীয় ফল করে বিজেপি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাজ্যের বিরোধী দলনেতার গলায় ঘর গোছানোর জোরালো দাবি শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও বিজেপির তমলুকের সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডলের বিজেপি–ত্যাগ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা।
প্রশ্ন উঠেছে, তাপসীর দলত্যাগের নেপথ্যে কি বিজেপির গোষ্ঠী কোন্দল দায়ী? তাপসীর দলত্যাগের ফলে ‘পরিবর্তনে'–র জেলায় বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ৭ থেকে কমে হলো ৬। প্রশ্ন উঠেছে, বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে তাপসীর দলত্যাগ কি বাকি বিজেপি বিধায়ক এবং অনুগামীদের মনোবলে ধাক্কা দিল? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দরজা একটু খুলে' দেওয়ার ফর্মুলাতেই কি ধস গেরুয়া শিবিরে? সেই দরজার বাইরে আরও অনেকে কি দাঁড়িয়ে?
২০২০–তে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বিজেপিতে যোগ দেন হলদিয়ার তৎকালীন বাম বিধায়ক তাপসী। ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনে হলদিয়া থেকে বিজেপির টিকিটে জিতে দ্বিতীয় বারের জন্য বিধায়ক হন তাপসী। ২০২১ বিধানসভায় পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি আসনের মধ্যে সাতটিতে জেতে বিজেপি। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে জেলার দু'টি আসনে বিজেপি জেতে। বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে জেলার ১৬টি আসনের মধ্যে ১৫টিতে এগিয়ে থাকে বিজেপি।
তার আগেই ২০২৩–এ তাপসীকে তমলুক সাংগঠনিক জেলার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলার রাজনীতিতে শুভেন্দুর অনুগামী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তাপসী। বিজেপি সূত্রের দাবি, ২০২৪–এ প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সাংসদ হওয়ার পরে দলে তাপসীর গুরুত্ব কমতে থাকে। সাংসদের সঙ্গে জেলা সভাপতির ‘মনোমালিন্য'–ও নাকি শুরু হয়। দিন কুড়ি আগে তমলুকে বিজেপির সমঝোতা বৈঠকে সাংসদ তহবিলের কাজ নিয়ে তাপসীর সঙ্গে অভিজিতের প্রবল বাকবিতণ্ডা হয় বলে একটি সূত্রের দাবি। সেই বৈঠকে ময়নার বিধায়ক, প্রাক্তন ক্রিকেটার অশোক দিন্দা এবং বিজেপির অন্যান্য নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রের দাবি, সেখানে তাপসী এবং অশোককে তুমুল ভর্ৎসনা করেন অভিজিৎ। সেই কারণেই কি দল ছাড়লেন তাপসী? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতার কথায়, 'অভিজিৎবাবু জেলায় তাঁর মতো করে সংগঠন চালাতে চাইছেন। জেলা সভাপতি হিসেবে তাপসী সেটা মেনে নিতে পারেননি। তাই এই দলত্যাগ।’
তাপসীর দলত্যাগের পরে সমাজমাধ্যমে বিজেপির দিকে কটাক্ষ ছুড়েছে তৃণমূল। কেউ লিখেছেন, 'তৃণমূল দরজাটা একটু ফাঁক করতেই বড় মাথা ঢুকে গেল। আরও বড় ধামাকা অপেক্ষা করছে।’ কারও সরস মন্তব্য, ‘......রইল বাকি ছয়।’ জেলায় বিজেপির বাকি ছয় বিধায়কদের অনুগামীরাও বিষয়টি নিয়ে হতাশ। অন্য দল থেকে আসা নেতারাই বিজেপির ক্ষতি করছে — মত পুরোনো বিজেপি কর্মীদের। বিজেপির তমলুক নগর মণ্ডলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সুজিত বেরা বলছেন, ‘তৃণমূল, সিপিএম থেকে আসা লোকজন আমাদের দলে এসেই পদ পেয়ে যাচ্ছেন। বিজেপির পুরোনো কর্মীরা বঞ্চিত। দলের উচিত পুরোনো যোগ্য কর্মীদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া। না-হলে এ রকম দল বদলের খেলা চলতেই থাকবে। জেলা সভাপতির দলত্যাগ ভোটবাক্সে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে।’
রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে অভিষেকের ‘দরজা একটু খুলে' দেওয়ার টোটকাতেই গেরুয়া শিবিরে ধস নামানো সম্ভব হয়েছে। বিধানসভা ভোটের আগে কি আরও কোন বড় বিজেপি নেতা তৃণমূলে যোগ দেবেন? তৃণমূলের তমলুক জেলা সভাপতি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘লাইন দীর্ঘ। অপেক্ষা করুন। সব দেখতে পাবেন। রাজ্যে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ৭৭ থেকে ৬৫–তে নেমে এসেছে। জেলায় ৬। আগামী বিধানসভার পরে বিজেপি আর বিরোধী দল হিসেবে থাকবে না।’
বিজেপির তমলুক সাংগঠনিক জেলার সহ–সভাপতি দেবব্রত পট্টনায়েকের পাল্টা দাবি, ‘বিজেপিতে ব্যক্তির কোনও প্রাধান্য নেই। তাপসী মণ্ডলের দলত্যাগ ভোটবাক্সে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না।’