এই সময়, মেদিনীপুর: হাসপাতাল থেকেই হস্তান্তর হয়ে যাচ্ছিল সদ্যোজাত! খবর পেয়ে কোনও রকমে আটকালেন শিশু কল্যাণ সমিতির (চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি বা সিডব্লিউসি) আধিকারিকেরা। সম্প্রতি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা।
স্বামী বছর পাঁচেক আগে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। টিনএজার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকতেন মহিলা। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এক ব্যক্তির সঙ্গে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। সময় যত এগোয়, ক্রমে শরীরে ফুটে ওঠে সব লক্ষণ। লোকলজ্জ্বায় প্রথমে রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল তাঁর। অনেক ভেবেচিন্তে পরে এক উপায় বের করেন। সকলকে বলেন, পেটে টিউমার ধরা পড়েছে। অপারেশন করাতে হবে। পাশের জেলা থেকে এসে ভর্তি হয়ে যান মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে।
১৪ ফেব্রুয়ারি সেখানে পুত্রসন্তানের জন্ম হয় তাঁর। কিন্তু সেই সন্তানকে তিনি বাড়ি নিয়ে যেতে রাজি হননি। ছেলে–মেয়েকে কী বলবেন? পাড়া–প্রতিবেশী, আত্মীয়–স্বজনকেই বা কী জবাব দেবেন? নবজাতককে ফেলে চলে যেতে চেয়েছিলেন। সে কথা হাসপাতালে কয়েকজনকে বলেও ফেলেন। মুখে মুখে প্রচার হয়ে যায় তা। শিশুটিকে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে হস্তান্তর করে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে হাসপাতালেরই কয়েকজন। সেই সময়ে বিশেষ সূত্র মারফত সে খবর আসে জেলা শিশু কল্যাণ সমিতির আধিকারিকদের কাছে। বেআইনি ভাবে শিশু হস্তান্তর রুখতে তৎপর হয়ে ওঠেন তাঁরা। এদিকে নর্মাল ডেলিভারি হওয়ায় পরের দিনই প্রসূতি ও সদ্যোজাতকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
সে দিন ছিল রবিবার। সরকারি অফিস বন্ধ। এই অবস্থায় হাসপাতালের সুপারের কাছে লিখিত আবেদন জানান সিডব্লিউসি–র আধিকারিকরা। যাতে ছুটি হয়ে গেলেও সোমবার পর্যন্ত প্রসূতি বিভাগে রেখে দেওয়া হয় মা ও সদ্যোজাতকে। পরের দিন শিশুটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন আধিকারিকরা। ততক্ষণে সদ্যোজাতকে দত্তক নিতে চলে এসেছেন এক দম্পতি। যাঁরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁরাও শিশুটিকে নিয়ে যেতে রীতিমতো বাধা দেন। শেষে গ্রেপ্তারির ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করেন আধিকারিকরা। হস্তান্তর হওয়ার আগে প্রায় ছিনিয়ে আনা হয় সদ্যোজাতকে। শিশুটির মাকেও তুলে আনা হয় সিডব্লিউসি–তে। তিনি শিশুসন্তানকে নিতে আগ্রহী নন, সে কথা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়। শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় হোমে। মাসখানেক আগের এই ঘটনা মঙ্গলবার প্রকাশ্যে আনে জেলা সিডব্লিউসি।
পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) কেম্পা হোন্নাইয়া বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, প্রায় ২৩ দিন আগে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। মা বাচ্চাটিকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছিলেন না। আমাদের কাছে খবর আসে। আমরা ওই শিশুকে নিয়ম মেনে উদ্ধার করে হোমে রেখেছি।’
জেলা সিডব্লিউসি–র আধিকারিক সন্দীপকুমার দাস বলেন, ‘শিশুটিকে উদ্ধার করতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। হস্তান্তরের চেষ্টা চলছিল। আমরা চাইল্ড লাইনকে সঙ্গে নিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যাঁরা শিশুটিকে নিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকক্ষণ বোঝাতে হয় — এ ভাবে শিশু হস্তান্তর করা যায় না। নিয়ম মেনে দত্তক নিতে হয়। পরে তাঁরা বোঝেন। যাঁরা হস্তান্তরের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা বাধা দেন।’
নাম না প্রকাশের শর্তে এক আধিকারিক বলেন, ‘রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয় আমাদের। যাঁরা শিশুটিকে নিতে এসেছিলেন, তাঁরা পুলিশ অফিসারের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। হাসপাতালের কয়েকজন নার্স ও কর্মীও শিশুটিকে দিতে চাননি। অনেক কষ্টে শিশুটিকে উদ্ধার করি। কে বা কারা এই শিশুকে হাসপাতাল থেকে হস্তান্তর করতে চাইছিল, তা বোঝা গেল না।’ সিডব্লিউসি–র প্রোটেকশন অফিসার জয়ন্ত সিনহা বলেন, 'এমন বেগ আমাদের পেতে হলো কেন, সেটাই প্রশ্ন।’ জেলা শিশু সুরক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, ‘সদ্যোজাতকে হাসপাতাল থেকেই কাউকে হস্তান্তর করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল বলে আমাদের কাছে খবর আসে। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি হাসপাতাল সুপারের নজরে আনি। তিনি সহযোগিতা করেন।’
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের সুপার ইন্দ্রনীল সেন যদিও বলেন, ‘এমন খবর আমার কাছে নেই। এ ভাবে শিশু হস্তান্তর করা যায় না। এটা আইনত অপরাধ।’