সমীর মণ্ডল ■ মেদিনীপুর
মা-বাবা যেদিন খড়্গপুর স্টেশনে তাকে বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলেন, কে-ই ভাবতে পেরেছিলেন, ১২ বছরের অসহায়, মিষ্টি মেয়েটির আগামীর ঠিকানা হতে চলেছে ইতালি! মঙ্গলবার দিনটা যেন রাতারাতি পাল্টেই দিল সেই ছোট্ট মেয়েটির জীবন।
মেদিনীপুর বালিকা ভবন হোম থেকে সেই মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন ইতালির এক দম্পতি। ফিলিপ্পো মোরসিয়ানি এবং এলিনা রিঘি পেশায় চিকিৎসক। পরিবারের নতুন সদস্যকে নিয়ে দম্পতি উড়ে গেলেন ইতালির রেজ্জিও এমিলিয়া-তে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) কেম্পা হোন্নাইয়ার দপ্তরে দত্তক-প্রক্রিয়া শেষ করে সেই মেয়েকে তুলে দেওয়া হয় ইতালিয়ান দম্পতির হাতে। এই নিয়ে মেদিনীপুর হোম থেকে মোট দত্তক দেওয়া হলো ৬২ জন শিশুকে। যাদের মধ্যে ন'জন পাড়ি দিল বিদেশে। এর আগেও দু'জন শিশু ইতালি পাড়ি দিয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর।
২০১৯ সালে খড়্গপুর স্টেশন থেকে চাইল্ড লাইন উদ্ধার করে সেই মেয়েকে। তখন তার বয়স মেরেকেটে ছয়। এখন সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। স্টেশন থেকে উদ্ধারের পরে সেই নাবালিকার ঠিকানা হয়েছিল মেদিনীপুর বালিকা ভবন হোমে। শিশু সুরক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা সেই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন এমন কিছু তথ্য, যা চমকে দেওয়ার মতোই।
সেই মেয়ের বাড়ি আসলে মুর্শিদাবাদ জেলায়। বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মা ছিলেন অন্যের বাড়ির পরিচারিকা। ভাই-বোন মিলিয়ে তারা ছিল ন'জন। অভাবের কারণেই মা-বাবা এক দিন তাকে খড়্গপুর স্টেশনে বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলেন।
এই কাহিনি শোনার পরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শিশু সুরক্ষা দপ্তরের তরফে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল সেই নাবালিকার ঠিকানা খোঁজার জন্য। কিন্তু তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও ওই মেয়ের বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশেষে 'অনাথ' বলে ঘোষণা করা হয় এবং দত্তক দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) কেম্পা হোন্নাইয়া বলছিলেন, 'এ পর্যন্ত মেদিনীপুর 'শা' হোম ও বিদ্যাসাগর বালিকা ভবন হোম থেকে ৬২ জন শিশুকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ন'জন বিদেশে গিয়েছে। সেই তালিকায় এ বার ওই বালিকার নামও যুক্ত হলো। ইতালির এক চিকিৎসক দম্পতি ওকে দত্তক নিয়েছেন।'
জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সন্দীপ কুমার দাসের বক্তব্য, 'খড়্গপুর স্টেশন থেকে ওই বালিকাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া মেনেই মেয়েটিকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। ওঁরা ফরেন অ্যাডপশনের যাবতীয় নিয়ম মেনে অনলাইন পোর্টালে আবেদন করেছিলেন। দত্তক দেওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরে নাবালিকার ভিসার ব্যবস্থা করে তুলে দেওয়া হয়েছে ওই দম্পতির হাতে।'
এতদিনের নিঃসঙ্গ জীবনে এই দিনটা যেন এক্কেবারে নতুন। ছোট্ট মেয়ের চোখেমুখে খুশির জোয়ার। নতুন বাবা-মাকে পেয়ে সে খুব খুশি। আনন্দিত ইতালির চিকিৎসক দম্পতিও। দত্তক নেওয়ার পরে ওই দম্পতি জানান, ভবিষ্যতে তাঁরা এই মেয়েকে ডাক্তার করতে চান। সে ভাবেই তাঁরা তাকে লেখাপড়া শেখাবেন।