দিগন্ত মান্না ■ পাঁশকুড়া
দুয়ারে দোল। আর দোল মানেই আবির। দোলের সময়ে ফুলের পাপড়ি থেকে তৈরি ভেষজ আবিরের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ভেষজ আবিরের জোগান থাকে না। ফুল থেকে আবির তৈরির কোনও কারখানা না-থাকায় ফুলের উপত্যকা বলে পরিচিত পাঁশকুড়ায় নষ্ট হচ্ছে বহু ফুল। অনেক সময়ে চাষিরা দাম না-পেয়ে নিরুপায় হয়ে ফুল ফেলেও দেন।
অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বছর দুয়েক আগে ফুল থেকে আবির-সহ বিভিন্ন উপজাত সামগ্রী তৈরি এবং সুরক্ষিত ও উন্নত উপায়ে ফুলচাষের লক্ষ্যে পাঁশকুড়ায় গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় কেন্দ্র সরকার। কিন্তু এতদিনেও সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত না-হওয়ায় ক্ষুব্ধ ফুলচাষিরা।
ফুলচাষের মানচিত্রে রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর। এ জেলার পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, শহিদ মাতঙ্গিনী ও তমলুক ব্লকে ফুলের চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ফুলচাষ হয় পাঁশকুড়ায়। ফুলচাষকে কেন্দ্র করে পাঁশকুড়ার দোকান্ডায় প্রতি বছর শীতকালে পর্যটকের ঢল নামে। গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, করণ, বেল, জুঁই-সহ ২০ থেকে ২৫ রকমের ফুলের চাষ হয় পাঁশকুড়ায়।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ২০ থেকে ২৫ হাজার পরিবার ফুল চাষের সঙ্গে যুক্ত। পরোক্ষ ভাবে যুক্ত আরও ৫০ হাজার মানুষ। ফুল থেকে আতর, আবির, রংয়ের মতো উপজাত সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব। বহু বছর ধরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ফুলচাষিরা সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো তৈরির আবেদন জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ নজরে পড়েনি।
বছর পনেরো আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দত্ত ফুল থেকে আবির ও রং তৈরি করে পথ দেখিয়েছিলেন। সেই সময়ে সরকারি উদ্যোগে হাওড়ার ঘোড়াঘাটায় একটি স্কুলের বৃত্তিমূলক বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ফুল থেকে আবির ও রং তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে সেই প্রকল্প বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেও ফুল থেকে ভেষজ আবির ও রং তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে কয়েক বছর আগে সারা বাংলা ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধারমণ সিংহ এবং রাজ্যের উদ্যানপালন দফতরের মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি পদক্ষেপ চোখে পড়েনি বলেই অভিযোগ।
কাল বাদে পরশু দোল। অথচ ফুলের উপত্যকা, পাঁশকুড়াতেই সে ভাবে মিলছে না ভেষজ আবির। বছরভর যাঁরা ফুল ফোটানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাঁদেরকেও দোল মরসুমে রাসায়নিক আবিরেই ভরসা রাখতে হচ্ছে।
২০২৩ সালে জাতীয় উদ্যানপালন পর্ষদ এবং গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্পের সহযোগী সংস্থার মোট সাত জনের একটি প্রতিনিধি দল পাঁশকুড়া ব্লকের কেশাপাট, ডালপাড়া, গোঁসাইবেড় এবং কোলাঘাট ব্লকের কয়েকটি জায়গায় ফুলের বাগান পরিদর্শন করে। কয়েকটি জায়গায় ফুলচাষিদের নিয়ে পাড়া-বৈঠকও করেন ওই দলের সদস্যরা। তারপরে কলকাতায় জাতীয় উদ্যান পালন পর্ষদের অফিসে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা।
সেই বৈঠকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া এবং কোলাঘাটের ফুলচাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সুরক্ষিত উপায়ে উন্নত মানের ফুল উৎপাদনের প্রস্তাব দেয় জাতীয় উদ্যান পালন পর্ষদ। ফুলচাষিদের সরকারি উদ্যোগে ভিন রাজ্যে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়ার কথা ওঠে বৈঠকে। সুরক্ষিত উপায়ে ফুলচাষের যাবতীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথাও বলা হয়। ফুল সংরক্ষণের জন্য জেলায় পিপিপি মডেলে হিমঘর গড়ে তোলারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ফুল থেকে উপজাত সামগ্রী তৈরির প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টিও রয়েছে। কিন্তু গত দু'বছরে প্রকল্পের কোনও কাজ এগোয়নি বলে অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ফুলচাষিরা। সারা বাংলা ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নারায়ণচন্দ্র নায়ক বলেন, 'পূর্ব মেদিনীপুরে ফুল চাষের গুচ্ছ প্রকল্পের অনুমোদন অনেক আগেই মিলেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফুল থেকে আবির-সহ বিভিন্ন উপজাত সামগ্রী তৈরি হবে। কিন্তু আজও প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। কয়েকদিন আগে ফুলের দাম কমে যাওয়ায় পাঁশকুড়া, কোলাঘাট এলেকায় বহু ফুল ফেলে দিতে হয়েছিল। অথচ ওই ফুল দিয়ে ভেষজ আবির তৈরি করা যেত। অবিলম্বে প্রকল্প চালু করার দাবি জানাচ্ছি।'
রাজ্য উদ্যানপালন দফতরের ডিরেক্টর (প্রশাসন) দীপ্তেন্দু বেরা বলেন, 'পূর্ব মেদিনীপুরে ফুলচাষের গুচ্ছ প্রকল্প চালু করার ব্যাপারে কাজ এগোচ্ছে। এই প্রকল্পের মধ্যে ফুল থেকে আবির তৈরির বিষয়টিও রয়েছে। কোন সংস্থা এই কাজ করবে সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। আশা করি মে-জুন মাস নাগাদ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যাবে।'